ভুল রাস্তার মোড়ে


Leave a comment

কেক

বড়দিন মানেই কেক, সে নাহুমই হোক বা ষাটোর্ধ জেঠিমার কাজু-কিশমিশ আর বিনা ওয়াইনের কেকযজ্ঞ। কিংবা ইউটিউব দেখে ষোড়শী শাল্মলীর প্রথম প্রচেষ্টা। আর অয়নকে লুকিয়ে খাওয়ানোর দু-টুকরো।

মডিউলার কিচেনে সুদৃশ্য মাইক্রোওয়েভ ওভেন আজকাল। কিন্তু
প্রেশার কুকারের ঢিমে আঁচে কেকের দুধারে কর্কশ এক ভালবাসা তৈরি হত সেইদিন। সেই তিতকুটে খয়েরি মেঘের প্রাচীরের আড়ালে তুলতুলে মোহ।
“বাবাকে বলিস চেরি আর ভ্যানিলা এসেন্স যেন না ভুলে যায়”। আর তারপর রোজকার ময়দা-মাখন-দুধ-ডিমের একদিনের বিলিতি অভিসার। ধুলোমলিন তুলোর আবডালে মুখ টিপে হাসে প্লাস্টিক সান্তাবুড়ো।

বৈকালিক দুধ চা বা সান্ধ্য পুডিং, মাঝরাতের ওম পেরিয়ে লুকিয়ে খাওয়া এক টুকরো, বা পরদিন প্রাতরাশে কমলালেবুর বিকল্প – কিভাবে যেন সেই মায়া মায়া কেকটা শেষ হয়ে যায়।
পরে থাকে অচেনা শহরের সুপারমার্কেট, ৪০ টাকার মিনি প্লাম কেক আর একাকীত্ব।


Leave a comment

হৃদ- মাঝারে

বাড়িটায় ও একা সেদিন।  বাড়িটা একটু জঙ্গল ঘেরা কেমন যেন , আশেপাশেও বাড়িটারি বিশেষ নেই। দূর থেকে মাইকে হিন্দি গান  তাল আর শালগাছের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে একটা মিহি  আমেজের মত। সেদিন অষ্টমী। কিছুক্ষণ আগের একপশলা বৃষ্টিতে মাটির মিষ্টি গন্ধে ম ম করছে চারদিক। হৃদ একা জানলার ধারে বসে ছিল , হেডফোনে লো রিড এর “ ওয়াক অন দ্য ওয়াইল্ড সাইড” । বাড়িটায় ওর ঘরের রং গোলাপি আর আকাশির অদ্ভুত অন্তর্লীন একটা কম্বিনেশান; কী আশ্চর্য , বাবা তবে শেষে স্বীকৃতি দিল ওর পছন্দের?

হৃদ একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িময়, ওর বাড়িতে কাঁচের ছাদ , আকাশের টুপটাপ ঝরে পড়া গল্পগুলো ফুটে উঠছে ছাদের ক্যানভাসে।

টেবিলের ওপর পিকুমামার আমেরিকা থেকে এনে দেওয়া ব্যাটম্যান আর জি আই জো বসে খোশগল্প করছে, হৃদ পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে গেল। একটু দূরে বসে নিমিদিদির থেকে না বলে আনা চাইনিজ মেয়ে পুতুলটা অদৃশ্য একটা কাউকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে।

খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল হৃদ, অন্ধকারের দুধারে ঝাউগাছ, কুচি কুচি বরফ পড়ছে , ওপারে নার্নিয়া । আড়ালে সে দাঁড়িয়ে, মাথায় অলিভ পাতার মুকুট , একমুখ হাসি নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে।

একবার ফিরে তাকাল হৃদ। দেরাজ থেকে অস্কার ওয়াইল্ড মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। হৃদ আবেশে চোখ বুজে মিলিয়ে যেতে থাকল টুকরো টুকরো হয়ে, চোখ খুললেই দ্বীপের শেষ প্রান্তে মায়ের হাতে লাগানো পেয়ারাগাছের নীচে ওরা দুজন, একসাথে, কাঁধে মাথা রেখে ।

 

অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে চোখ খুলল হৃদ। হিয়া ওকে জাপটে ধরে চুমু খাচ্ছে।

 

হোটেলের হানিমুন স্যুইট থেকে ভিউটা অপার্থিব যাকে বলে।  সকালে উঠেই স্নান সেরে নিয়ে পর্দা সরালো হৃদ। সোনা-গলা পাহারচূড়ো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে রামধনু দ্যুতি, শৈশবীয় উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে খরস্রোতা ঝোরাটায়। হিয়া কী যেন নাম বলল নদীটার? পাহাড়িয়া গানের গন্ধ ছিল নামটায়, ইশ কিছুতেই মনে পড়ছে না। না মেয়েটা খুঁজে খুঁজে জায়গা চুজ করেছে বটে। হিয়ার বুক করা। বিয়ের ৩ মাস আগে থেকেই হানিমুনের টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং, ট্যুর প্ল্যান সব করে রেখেছে হিয়া।

হৃদের একবার মনে হল হিয়াকে ডেকে দেখায়। না থাক, কাল সারাদিন যা জার্নির ধকল গেছে, থাক ঘুমোক, আরও তো ৩ দিন আছে এখানে। উঠলেই অবশ্য ওই পাহাড়ি ঝোরাটার মতই প্রাণোচ্ছলতায়  ঝলমল বয়ে চলবে মেয়েটা। হৃদের খুব রাগ হল নিজের ওপর।

 

ওদের বিয়েটা আরেঞ্জড। বাবার কলিগের মেয়ে হিয়া, অনেকদিন ধরেই পরস্পরের পারিবারিক পরিচয়।

হৃদ বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট , প্রেম ট্রেম ও করেনি কোনোদিন।  এক্সিকিউটিভ প্রমোশনটা হওয়ার পরে পরেই বাবা একদিন রাত্রে খেতে বসে প্রস্তাবটা দিল, হৃদ বিনা বাক্যব্যয়ে ছাঁদনাতলায়। এবং এখন আপাতত হিমালয়ের কোলে ।

কফি দিয়ে গেল এইমাত্র, হিয়া স্নানে ঢুকেছে। হৃদ আয়েশ করে কম্বলটা  জড়িয়ে জানলার ধারে কাপটা নিয়ে বসেছে, শিল্পী ফোন করল এর মাঝে।

“কিরে দাদাভাই ! কংগো। পঁচিশেই হাতকড়াটা পরে ফেললি?”

“থ্যাঙ্কস। তোদের কি খবর বল, বিয়েতে এলি না তো? তোর শাশুড়িমা ঠিক আছেন এখন?”

“ হ্যাঁ ওই আর কি, বাড়িতেই এখন, কমপ্লিট বেড রেস্ট। ইশ কি যে মিস করলাম তোর বিয়েটা!”

“ কি আর করবি!”

“তারপর বল, খুব হানিমুন করছিস নিশ্চয়ই?” বোনের গলায় দুষ্টুমির আলতো আভাস “আমার বৌদি কোথায় এখন?”

“স্নানে গেছে।’’

“তারপর, তিনি তো সেই লেভেলের খুশি, কি বল? ’’

“হ্যাঁ সে একটু আছে বটে। ’’

“হু হু, হবে না? এতদিনের প্রেম? পুরো তো রম-কম মুভি মুভি গন্ধ ব্যাপারটায়।’’

শিল্পীর কথাটা বুঝে উঠতে সতর্ক হয়ে উঠল হৃদ।

“মানে?”

“ন্যাকামো করিস না তো দাদাভাই, অ্যাজ ইফ তুই কিছু জানিসনা…”

হৃদের প্রান্ত থেকে কোন সারাশব্দ না আসায় ঘাবড়ে গেল শিল্পী।

“ দাদাভাই তুই সত্যিই জানতিস না হিয়াদি লাইকড ইউ অল আলং ? ও তো বলে তুই রেসপন্ড করতিস না সেরকম, আমরা তো ভাবতাম ওটাই তোর সিগনেচার । ’’ মুচকি দুষ্টুমি ছুঁড়ে দেয় শিল্পী।

“শিল্পী, পরে কথা বলব রে, বেরোতে হবে।”

 

বাথরুমে শাওয়ার বন্ধ করতেই হিয়ার কানে আসে একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ, কেউ যেন বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদছে। তোয়ালেটা কোনোমতে জড়িয়ে ছিটকে বেরোয় হিয়া।

“হৃদ, অ্যাই হৃদ, কি হয়েছে তোমার? ’’ একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলকে উদ্বিগ্নতা মিশে যায়।

সাদা চাদরের সাথে লেপটে থাকা মানুষটাকে বেশ খানিকক্ষণ ধরে ঝাঁকায় হিয়া।

হৃদ মুখ তুলে হিয়ার দিকে তাকায়, ভীষণ অপ্রত্যাশিত একটা দৃষ্টি।

“কি হয়েছে তোমার? এই তো আমি, প্লিজ বলো।’’

“ অ্যাম সরি হিয়া, অ্যাম রিয়েলি সরি।’’ হৃদ কান্নায় ভেঙে পরে। এতদিনের চেনা এত ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটাকে এভাবে বেআব্রু দেখে হিয়ার দিশেহারা লাগে নিজেকে। হৃদের মাথাটা নিজের কোলের ওপর রেখে আস্তে আস্তে  হাত বুলিয়ে দেয়।  অসাবধান হয়ে আসে তোয়ালের ইচ্ছাকৃত ব্যারিকেড, সদ্যসিক্ত হিয়া হৃদের হাতটা তুলে দেয় বুকে।

হাতটা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সরে যায়, উঠে দাঁড়ায় হৃদ। বাথরুমের দরজা খোলা রেখেই মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে থাকে, দিতেই থাকে । যেন অস্পৃশ্য কিছুর ছোঁয়ায় ওর সমস্ত কিছু চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে দ্রুত। একবুক ভাঙা চাঁদের স্বপ্ন নিয়ে হিয়া এলিয়ে পরে বিছানায়।

 

 

মানালি থেকে ফিরে আসার প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। নতুন ফ্ল্যাটটা নেওয়া থাকলেও আপাতত হৃদের বাড়িতেই আছে ওরা। নতুন জার্নি শুরুর ঝাঁঝটা অনেকটাই মিইয়ে গেছে । দুজনের মধ্যে কথা বিশেষ একটা হয় না। তবে অমিল নেই।

মানালির ওই ঘটনাটার পর আর যে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটেছে তাও নয়। হৃদকে বারবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও ও এড়িয়ে গেছে , শেষে হাল ছেড়ে দেয় হিয়া। বাকি দিনগুলো ভালোই কেটেছে। সেই চাঁদের আলোয় নদীর ধারে ওরা সেদিন বসেছিল, আর পাইন – ঝাউগাছেরা চুপজগতের রূপকথা শোনাচ্ছিল, হঠাৎ হৃদ নিজের থেকেই শেলি ধরল। হিয়া বিমোহিত হয়েছিল আরও একবার, যেন হিপনোটাইজ। হৃদ নিজের থেকেই ওর কপালে আলতো করে চুমু খায় সেদিন। হিয়া সামলাতে পারেনি, বুনো লতা আর পাহাড়িয়া রাতের তারাকে সাক্ষী রেখে ওদের মিলন হয়েছিল।

 

সেদিন হিয়া অফিস থেকে ফিরল একটু দেরি করে, হৃদ চুপচাপ ঘরে টিভি দেখছিল। বরকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য পেছন থেকে একহাতে চোখ টিপে ধরে আরেক হাতে নাকের সামনে কোলোণের বোতলটা মেলে ধরল।

“হিয়া? সে কি! তুমি কি করে জানলে?” হৃদের এরকম অমলিন হাসি অনেকদিন বাদে দেখল হিয়া। বুক থেকে যেন একটা চাপা ভার নেমে গেল।

“গেস হোওয়াট। আজকে কার সাথে দেখা হল জানো?’’

বাচ্চাদের মত ঔৎসুক্য আর উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকানো হৃদের মুখটা দেখে একপশলা হেসে নিল হিয়া।

“মাজহার কে মনে আছে? আমার কলেজের বন্ধু, আরে তোমার সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম না? সেনকাকুর ছেলের জন্মদিনে?”

পলকে যেন অকালবর্ষা নেমে এলো হৃদ জুড়ে। থমথমে মেঘের মাঝে একচিলতে রোদ্দুরে হাসি ফুটিয়ে হৃদ বলল, “ ও তাই? কোথায় দেখা হল? কেমন আছে ও ?”

“ভালোই তো, উইপ্রো ছেড়ে ইনফোসিস এখন। বলল তো নতুন চাকরির চাপ তাই বিয়েতে আসতে পারেনি। কংগ্রাটস , অল দ্য বেস্ট অনেককিছু বলল- টলল। আমি তো তোমার জন্য পারফিউম খুঁজছিলাম, তখনই দেখা হল। ওই এটা নিতে বলল, বেস্টসেলার নাকি। এই এই জানো, ’’ হিয়া হাসি চেপে গলা নামিয়ে বলে , “ এখনও ওরকমই লেডিস লেডিস হাবভাব, গার্লফ্রেন্ডও তো জুটল না এতদিনেও।’’ হিয়া বলে চলে, “ এই জানো তো, প্রত্যুষ বলছিল মাজহারের সাথে নাকি ওর বাড়ির লোক যোগাযোগ রাখে না , মোস্ট প্রবাবলি হি ইজ গে, দ্যাটস হোওয়াই।’’

নিরুত্তাপ গলায় “ ও ’’ বলে উঠে যায় হৃদ। হিয়া পিছু ডাকে,

“ আরে কোথায় যাচ্ছ , শোনো না? একদিন ওকে আসতে বললাম , নতুন ফ্ল্যাটে। এই কবে যাব বলো না প্লিজ।’’ হিয়া আদুরে গলায় আবদার জানায়।

উত্তর না দিয়ে ধীরপায়ে বাথরুমে ঢুকে যায় হৃদ।

 

পারতপক্ষে হৃদের ফোন, ল্যাপটপে হাত দেয় না হিয়া। ওটুকু স্পেস না দিলে সম্পর্ক টেকে না বলে ও মনে করে। তবু কদিন ধরে হৃদের অদ্ভুত এই ডিপ্রেশন , অনীহা, কেমন একটা উইথড্রন যেন সবকিছু থেকে, ঘরে বসেও সারাক্ষণ কোথায় যে পড়ে আছে ঠিক নেই। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল হিয়ার ওর ফোন চেক করে। নিশ্চয়ই কোন অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছে, নাহলে আর কদিন বাদে বাবা হতে চলেছে, খবরটা জেনেও কি করে কেউ এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারে? হৃদের মত ছেলে, ওর পেট থেকে কথা বার করা সহজ নয়, এতদিনে এটা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে হিয়া, রাগও হয় মাঝে মাঝে খুব।

এখন হিয়ার সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হল হৃদের সাপোর্ট। দুটো প্রাণী মাত্র এই এত্ত বড় ফ্ল্যাটে, হিয়ার ফার্স্ট টাইম প্রেগনান্সি, কি করে সামলাবে? হৃদ কি বোঝে না কিছু? না কি? ভাবতে বসলেই হিয়ার বাঁধ ভেঙে জল আসে। নিজেই তো পছন্দ করেছিল লোকটাকে। খুব অভিমান হয় নিজের ওপর, মা বাবা কেন আটকাল না আমাকে? আইভরি রঙা দেওয়ালের কাছে হিয়া সব বলে, কেঁদে হালকা হয়।

সেদিন রোববার । দুপুরে আইপ্যাডে  খুটখুট করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল হৃদ। হিয়া পাশে বসে বই পড়ছিল। হিয়ার মাথায় রোখ চেপে গেল হঠাৎ, মনকে ঠিক বেঠিকের হিসাবের সুযোগ না দিয়েই সন্তর্পনে ঘুমন্ত হৃদকে পেরিয়ে আইপ্যাডটা নিজের কাছে নিয়ে এলো।  ফেসবুক খোলা।

আলতো করে চ্যাট লিস্টে হাত ছোঁয়াল। সবার ওপরেই মাজহারের নাম।

স্ট্রেঞ্জ? হৃদ মাজহারের সাথে যোগাযোগ রাখে? কোনোদিন বলেনি তো?

মাজহারের আনরিড টেক্সট। বিনা দ্বিধায় খোলে হিয়া।

“ বাবু? ঘুমিয়ে গেলে? লাভ ইউ। কাল আসবে কখন বলে দিও। ’’

হুহ??? দুয়ে দুয়ে চার করতে পারেনা হিয়া ঠিক, এটা মাজহারই তো? হ্যাঁ ওর ছবিই তো দেখাচ্ছে?

হিয়া বশীভুতের মত স্ক্রোল ব্যাক করতে থাকে।

দেড় ঘন্টা বাদে হৃদ ঘুম ভেঙে দেখে বিস্ফারিত জবাফুলের মত চোখ নিয়ে ওর দিকে স্থির তাকিয়ে আছে হিয়া, কোনওক্রমে অস্ফুটে বলে, “ কেন করলে হৃদ? কেন?’’

 

 

 

“আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না, কোনওদিন না।’’

ডাঃ মিত্রের চেম্বারের ভেতরটা এসি হলেও সবসময়েই খুব সাফোকেটিং লাগে হিয়ার। দেওয়ালগুলো হাজার মানুষের হাজার দুঃখ নিয়ে মহীরুহের মত গাম্ভীর্য নিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে সবসময়।

ডাঃ মিত্র সব শুনে প্রতিবারের মতন প্যাডে খসখস করে কলম চালান। আজকাল আর জিজ্ঞেস করেন না সবকিছু, শুধু ওষুধগুলো লিখে দেন। হিয়াও ক্লান্ত, এক জিনিস বারবার বলে বলে তার বোঝ আরও বাড়ে বই কমে না। তবুও আজকে বেরনোর আগে ডাঃ মিত্র আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “ হৃদের সাথে কথা হয়?”

অল্প ঘাড় নেড়ে দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে যায় হিয়া।

 

গত দু’বছরের ফ্ল্যাশব্যাক চলবে এবার সমস্ত বাসজার্নি জুড়ে।

কি করে ক্ষমা করবে নিজেকে হিয়া? মাজহারের সাথে হৃদের আলাপ? সেও তো হিয়ার সূত্রে।

হৃদের সাথে বিয়ে, জোর করে বারবার মিলিত হওয়া, হাসিমুখে সংসার যেন কোথাও কোন ফাঁক নেই, সবই তো হিয়ার নিজেরই বাবল অফ ফ্যান্টাসি। ও কি বুঝতো না হৃদের খামতিগুলো? অনীহাগুলো? তবু কেন বরাবর প্রশ্রয় দিয়ে এসছে নিজের মুখোশ পরা স্তোকবাক্য গুলোকে?

 

হিয়ার প্রেগনান্সির খবরটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্রে জেনেছিল মাজহার। সেই যে রোববার দুপুর ছিল, সেই সপ্তাহেরই বুধবার পোস্ট দিয়েছিল হিয়া। সেটা কি ইচ্ছাকৃত ছিল না? পারবে হিয়া অস্বীকার করতে আজকে? দুদিনের মধ্যে হিয়া চলে এসেছিল নিজের মায়ের কাছে। হৃদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চায়নি আর, অভিমান, বিতৃষ্ণার বশে কিছু না ভেবেই।

দুদিন পরে হৃদ ফোন করেছিল, মাজহারের আত্মহত্যার নিউজটা দিতে শুধু। ওর গলার কান্নায়  স্পষ্ট মিশে ছিল শ্লেষ , অনুচ্চ একটা ঘৃণা, হিয়ার প্রতি। সেই শেষ কথা বলা হৃদের সাথে। এখনও লিগ্যাল ডিভোর্স হয়নি ওদের ।

 

সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের শেষের দিকে, সাড়ে পাঁচ মাসে মিসক্যারেজ হয় হিয়ার। এক রোববার বিকেলে। মা ছিল রান্নাঘরে, বাবা টিভিতে মগ্ন। ছাতের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেছিল। সাথে সাথে এ্যাম্বুলেন্স , ছোটাছুটির মাঝে চাপা পড়ে গিয়েছিল সিঁড়ির নীচে পড়ে থাকা হিয়ার কলেজ বয়েসের স্টিলেটো জোড়া।

 

বাসে পাশে বসা লোকটার অসহ্য চাহনি সরিয়ে একবুক ঘেন্না আর কান্নায় নিজেকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল হিয়ার। ভারী চোখের পাতায় ঝাপসা জানলা দিয়ে আকাশ ডাকল হিয়া।

বৃষ্টিস্নাত পূর্বকোণে একটা রামধনু ফুটে উঠছে ।


Leave a comment

তারাদেরও স্বপ্ন ভাঙে

তেতোমুখে মা কে এককাপ চা দিতে বলে পেপারটা নিয়ে এসে বসে স্বপ্ন। আজকাল এটাও পড়া হয় কালেভদ্রে, দেরাজের সার সার বইয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও। তিন দিনের না কামানো গাল পেরিয়ে হাত থমকে দাঁড়ায় চোখের কোটরে। সেন্টার টেবিলে কাচের নিচে গোঁজা ছেলের রিপোর্ট কার্ড থেকে ইলেকট্রিক বিল। সেকি! সায়েন্সে মাত্র ১৬ ! সই করার সময়ে খেয়ালও করেনি। আগে বড় যত্ন নেওয়া হত ছেলেটার , আর এখন। কেমন যেন আটকে আসে স্বপ্ন-র গলার কাছটা। অদূরে রাখা নতুন পেটেন্ট পাওয়া পাওয়ার ইনভার্টার ঢেকে এসে দাঁড়ায় স্বপ্ন-র ছোটবেলা। চোখ ডলতে ডলতে জড়ানো গলায় বলে, “মা কোথায়?”
“আসবে বাবু। ফিরিয়ে আনব তোর মা কে।“ বলতে বলতে ভিজে যায় হলুদ রঙের কার্টুন আঁকা ছোট গেঞ্জিটা।

ছিঁড়ে ফেলা কার্ডটা ত্রস্তহাতে কুড়োতে থাকে শ্রমণা। প্রাণপণ আড়াল করা সত্ত্বেও অবাধ্য দু-চার ফোঁটা ন্যাকামি ভিজিয়ে দেয় দুবার সেলাই করানো চটিটার কোনা। অপটু হাতে আঁকা কার্ডের টুকরোর সঙ্গে বেনামি আধপোড়া সিগারেট আর ঘুণধরা একটা সম্পর্কের ঝুরোবালি ব্যাগবন্দি করে দ্রুত পা চালায়। ক্ষয়াটে মুখটার দিকে ঝাপসাভাবে আসছি বলে এগিয়ে চলে। আরেকটু স্পিড বাড়ালে ১২-৩৫ এর লোকালটা নিয়ে যাবে মুখটার থেকে নিরাপদ দূরত্বে।

“তোর কোন কমন সেন্স নেই? দেখিস তো সারাদিন কেমন পাগলের মত খাটে ছেলেটা? তাও এরকম করিস তুই ! তোর মা তো ওর জন্যই স্বাভাবিক…”
বাবার একটানা বলে চলাগুলো শ্রমণার কানে আবছা হয়ে আসতে থাকে। কিবোর্ড আর মাউস হা করে গিলতে থাকে মনিটরে ফুটে ওঠা একটা মেয়ের পরপর পাল্টে চলা ভিন্ন ভঙ্গিমার ছবির। মাউস ফিসফিস করে, আবার আরেকটা। কিবোর্ড উত্তর দেওয়ার আগেই অপর একটা নাম আবার ফুটে ওঠে স্ক্রিনে।
কিবোর্ড অনুভব করে শেষে ভেজা চোখে ফোলা ঠোঁট নিয়ে শ্রমণা অভ্যেস মত সেই বোতামগুলো টিপছে আবার। যাক শান্তি , আজকের মত। ডাউন কারসর কে সজাগ থাকতে বলে বাকিদের ঘুমোতে যাওয়ার অনুমতি দেয় ।
ঘুমের ঘোরে ভিজে জেগে ওঠে শ্রমণা। স্বপ্নে কেন আবার পুরনো কামের গন্ধ !

আজ যাবে না স্বপ্ন অফিসে। কোম্পানি নিজের হওয়ার এই একটা সুবিধা থাকলেও স্বপ্ন সেটার ব্যবহার করেছে এমন নজির বিরল। কমদিন তো পিশাচগুলোর খিদমতগারি করেনি, তবু জিগীষা কে কোনোদিন মরতে দেয়নি। এটাই স্বপ্ন তার সাফল্যের মন্ত্র বলে জানায় স্টুডেন্টদের।
বক্তৃতাগুলো দিতে দিতে স্বপ্ন মনে মনে প্রত্যয় অনুভব করে, জীবনে অনেক প্রলোভন , অনেক ডিসট্রাকশন উপেক্ষা করেছে বলেই না আজ এই জায়গাটা।
তবু কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা। পাত্তা দেয় না স্বপ্ন, হাসিমুখে উত্তর দেয় পরবর্তী প্রশ্নের।

পরদিন সারাটাদিন মুখ গোঁজ করে বসে থাকে শ্রমণা। প্রিলিমস ক্লিয়ার করেছে অক্লেশে , আর ৪ দিন বাদে মেইনস; উতরোলেই চাকরিটা হয়ে যাবে। সব অপমানের শোধ তুলতে পারবে হাতে টাকার জোরটা এলে। দাঁতে দাঁত ঘষে শ্রমণা। কিন্তু শিথিল হয়ে যায় অচিরেই। ওয়েদারটা এত ভালো।
এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন।
সব অভিমান গলে জল মেয়ের।
পরপর পাঁচবার কল করার পরেও উত্তর না পেয়ে দুশ্চিন্তিত হতে গিয়েও আটকে যায়, ঠিকই তো, জীবনটা হিন্দি ধারাবাহিক না, মুহুর্মুহু কহানি মে টুইস্ট আসবে। আবার আষাঢ়ে মেঘ ভর করে বৃষ্টি নামে চরাচর ছাপিয়ে।

ছেলের গা মুছিয়ে গামছাটা বারান্দার কোণে শুকোতে দিয়ে স্বপ্ন আড়চোখে দেখে নিল রোদের দিকে মুখ ফেরানো ইজিচেয়ারটাকে। রোজকার দৃশ্য, তবু কেমন একটা মায়া হল আজ বড় । আহারে বড্ড চড়া রোদ ওদিকটায়। আলতো করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই একটা বিকৃত দৃষ্টি প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে স্বপ্ন-র দিকে তাকাল। “চলে যাও, চলে যাও। আমি একা থাকব। একা থাকব আমি!” চিৎকারে ছিটকে স্বপ্ন কোনোমতে পালায় ছেলের বিস্ফারিত দৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে। মনে পড়ে যায় এক চড়া রোদের দুপুরের কথা। সেদিন স্বপ্নর বড় ইচ্ছে করছে এসব ফাইলপত্তর , সার্কিট ব্লুপ্রিন্ট ধুত্তোর বলে টান মেরে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে একটা ছাতার তলায় ঢুকতে। আর তারপর দুজনে মিলে মিয়নো ঝালমুড়ি আর আদর খাবে। বসের রাঙাচক্ষু উপেক্ষা করে ফোনটা হাতে নেয় সন্তপর্ণে। কল লিস্ট খোলার আগেই চোখ আটকায় ফেসবুক নোটিফিকেশানে। প্রাক্তনীর স্ট্যাটাস আপডেট। সরকারি চাকরির সিকিওরিটিকে ঘিরে রাখা অভিনন্দনের বন্যায়। একশটা মৌমাছি হুল ফোটানোর মত যন্ত্রণা হল যখন পরমুহুরতেই চোখ পড়ল টেবিলে রাখা মামুলি ফন্টের আইডি কার্ডটায়। এর ফাঁকেই ফের লালবাতির আর্তনাদ, আবার আরেকটা ব্রেকডাঊন। এই মুহূর্তটায় যখন ফোনটা ঝনঝন করে সুরলহরী তুলল, স্বপ্ন-র কানে সেটা সাইরেনের মত বিষাক্ত। তবু আলগা আবেগ এনে হ্যালো বলতেই যখন ওপার থেকে দুদিনের জমানো অভিযোগের বন্যা ভেসে এল, স্বপ্নর থুথু ছেটাতে ইচ্ছে হল নিজের গায়ে।
আর কোনোদিন কি ফিরে পাবে ওই এক ছাতার তলার দুপুর আর মিয়ানো ঝালমুড়ি?

চাকরিটা শ্রমণা পায়নি। এই নিয়ে কত নম্বর ব্যর্থতা হিসেব হারিয়ে ফেলেছে ও। ফের সেই এক রাউন্ড ব্লেডের অভিযান সারা শরীর সব নিভৃত অঞ্চল জুড়ে, আর লুকিয়ে রক্তভেজা রুমালটা ফেলে দেওয়ার ত্রস্ততা । কথা ছিল এইটাই লাস্ট চান্স, এরপর বিয়েটা করতেই হবে। পাত্র তো ঠিকই আছে, শ্রমণার নিজের পছন্দ , মা বাবার অত্যন্ত স্নেহের। আর কার কি বলার থাকতে পারে ? হইহই করে বিয়েপর্ব , হানিমুনপর্ব মিটে গেল। ডানা মেলা বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের মাঝে শ্রমণার মনে দানা বাঁধতে থাকে মায়ের একসময়ের অবস্থার আশঙ্কা। সেই নিদ্রাহীন রাত্রি, সেই কাউন্সেলর , সাইকিয়াট্রিসট , পারানইয়া, ওষুধের গন্ধে আচ্ছন্ন মা। শ্রমণার বরেরই কৃতিত্ব যদিও আজকে মা-র অনেকটাই সুস্থ জীবনে ফেরার পেছনে, তবু দুজনের রাতদিন ভীষণ ঝগড়ার মাঝের মেনটাল পেশেন্ট , ডাক্তার দেখানো উচিত তোমার প্রভৃতি বিশেষণ গুলো কি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন?
কে বলতে পারে সেই রক্তবীজটা কোনোদিন প্রকট হয়ে উঠবে না, শ্রমণা বা তার হবু সন্তানের মধ্যে? আড়ালে থাকা সাতমাসের পরিপূর্ণ শরীরটায় হাত বুলিয়ে চোখের জলকে বশ মানায় শ্রমণা।

এই বয়েসে স্বমেহনের ধকল আর লজ্জা কোনটাই মেনে নেওয়া যায় না। তবু কি আর করা যাবে, শারীরিক চাহিদা পরিত্যাগ করার মত ক্ষমতা থাকলেও একেকবার বিদ্রোহ করে ওঠে ইন্দ্রিয়গুলো। শেষ কবে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে মনে নেই স্বপ্নর।
পরের দিকে কেমন জড়ের মতো পড়ে থাকত মেয়েটা। হাজার চেষ্টা করেও স্বপ্ন জাগাতে পারত না, বিরক্ত হত ও, স্বপ্নকে ঠেলে সরিয়ে দিত। জোর করতে গেছিল একবার, সে কি বীভৎস চিৎকার। এই মেয়েটাই একদিন স্বপ্নর কাছে দিনে রাতে যখন তখন গা ঘেঁষে এসে বসত , গালে গাল ঘষত, আর গভীর চুম্বন।
ইশ, সেদিনও যদি স্বপ্ন জানতে পারত এই অনীহা- নিস্পৃহতার কারণটা। ইশ, বড্ড দেরি হয়ে গেল, বড্ড।

সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাজব্যান্ড । তখন বোধহয় নিজের কোম্পানি খুলবে বলে তোড়জোড়। সারাদিন ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা , কপালে ভাঁজ । নাওয়া খাওয়ার সময় নেই, ছেলেকে আদর করা তো দূরের কথা। ছেলেকে শ্রমণা একা হাতেই সামলেছে বরাবর। সংসারের বাকি কাজও । সারাদিনের পর শ্রমণা রাতের দিকে ঘন হতে চাইলে তা ফিকে পড়ে যেত ল্যাপটপের নীল বিমোহিনী আলোয়। একদিন জেদ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিতেই দক্ষযজ্ঞ। রাগের মাথায় শ্রমণা উগড়ে দিল এতদিন জমিয়ে রাখা সন্দেহগুলো।
কোন দ্বিতীয় বাক্যব্যয় ছাড়াই সেদিন শ্রমণার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গিয়েছিল স্বপ্ন। শুধু শ্রমণার শ্রবণ এড়ায়নি অস্ফুটে বলা “একদম মায়ের মত “ । সেদিনই যা ডিসিশন নেওয়ার নিয়ে নিয়েছিল শ্রমণা।

ছেলে যেদিন খেলনা খুঁজতে গিয়ে বিছানার তোষকের তলায় লুকিয়ে রাখা ফাইলগুলো টেনে বের করল, তদ্দিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। স্বপ্ন ততদিনে নিজের মা কে বাড়িতে এনে রেখেছে বাচ্চাটার দেখভালের জন্য মূলত । নিজে আর সময় পায় কোথায়?
প্রায় দুবছর আগে থেকে জমানো ফাইলগুলোতে যে ভারী ভারী ওষুধের নামগুলো লেখা ছিল প্রায় সবই খুঁজে পেল স্বপ্ন … ড্রয়ার, আলমারির এদিক ওদিক। রাখার কোনও ঠিক নেই, প্যাটার্ন নেই। চরম ধাক্কাটা খেলো ওপরের পেশেন্ট নেমটা
দেখে।
শ্রমণার মায়ের নাম।
স্বপ্ন-র মনে পড়ে যায় হানিমুনে গোয়ার ময়ূরনীল জলকে সাক্ষী রেখে শ্রমণার আশঙ্কার উত্তরে বলেছিল , “চুপ, আমি আছি না।“


Leave a comment

নস্টালজিয়া- ১ আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড

এখন যতই আমার শহর, ভেজা কাঁচের ওপারের হ্যালোজেন, নস্টালজিয়া নিয়ে রোম্যান্টিসিজম করি না কেন; আমার ছোটবেলাটা কিন্তু শহুরে হতে হতেও হয়নি… আর তার জন্য এখন খুব নিশ্চিন্ত লাগে।

আমরা থাকতাম সাউথের এক কলোনি এলাকার একটা ভাড়াবাড়িতে। বাড়িটার বাইরের রংটা ছিল অদ্ভুত একটা শ্যাওলাটে গোলাপী, একতলার যে দুটো ঘর জুড়ে থাকতাম সেখানে ছিল হালকা সবুজ। একটা ঘরের দেওয়াল জুড়ে ছিল অ্যাবস্ট্রাক্ট মিউরাল। না ভাই, ওটি কচি আমির শিল্পকর্ম । ক্রেয়নের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আঁকার স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে অবধি চলেছিল সেটা। তালগাছ থেকে গুপী-বাঘা, মা বাবা থেকে প্রথম দেখা পুরীর সমুদ্র কেউ বাদ যায়নি।

বাড়িটার সামনে পেছনে জুড়ে অনেকটা জায়গা ছিল। অযত্নলালিত একটা বাগান আর অচেনা গাছপালায় ভর্তি। দেশের বাড়িতে অনেক বড় জায়গা, বিশাল আম-জাম- কাঁঠালের বাগান থাকা সত্ত্বেও কেন জানি ওই শহুরে নামের আড়ালে ফিক করে মুচকি হাসা বাগানটা অনেক বেশি আপন ছিল।
যদ্দুর মনে পড়ছে, সামনের ক্যাঁচ করে আওয়াজ করা বড় লোহার গেটটার সদর দরজা বরাবর রাস্তাটা ছিল বাগানের বুক চিরে । আর ওই রাস্তার দুপাশে ঠাকুরপুজোর সাদা ফুল, অসম্ভব একটা বেগুনি নীলকণ্ঠ ( যেই প্রজাতি আমি সারাজীবনে আর কোথাও দেখিনি) , লাল আর ক্রিম রঙের জবা, স্থলপদ্ম , কলাবতী আর অনেক পাপড়ির একটা গোলাপ গাছ ছিল। এককোণে খুব নিচু একটা তুলসীবেদি। লাল সিমেন্টে বাঁধানো। আর বাগানের মাঝখান জুড়ে ছিল একটা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো গোলাপি জবার বিশাল গাছটা । মূল কাণ্ডটা এমনভাবেই বেঁকা ছিল যে ছোট্ট আমি বাড়িওয়ালা জেঠুর হাজার বারণ সত্ত্বেও লুকিয়ে সেখানে বসে দোল আর ম্যাঙ্গো বাইট খেতাম। আর ছিল একটা অব্যাবহৃত সিমেন্টের কুয়ো , যার স্থবির জলে সবজে আলো ফেলত ওই জবাগাছ আর একটা কাগজিলেবু গাছের একসাথে সুখে সংসার করা পাতারা। যখন একটা চাইনিজ কাট চুলের দুষ্টুমিতে ভরা মুখের প্রতিবিম্ব পড়ত সেই মায়ানগরীর আয়নায়, তার গভীর কৌতূহলী চোখে কুয়োর ভেতর থেকে চেশায়ার ক্যাট বা হোয়াইট র্যা বিটের দেখা পাওয়ার অপেক্ষা।

মায়ের হাজারো বারণের মধ্যে অন্যতম ছিল কুয়োয় উঁকি দিবি না। বলা বাহুল্য , তাঁর দুপুরের ঘুমের সুযোগ নিয়ে চুপি চুপি দরজা খুলে সেটিই করা হত। শেষে দেখানো হল ছেলেধরার ভয়। যারা তোষক- বালিশ বানানোর তুলো ধোনার যন্ত্র নিয়ে হাঁক পাড়তেন পাড়ার মাঝে, কেন জানিনা মনে গেঁথে গেছিল তারাই ছেলেধরা। আর ভয় পেতাম কেজিদরে কাগজ কেনার লোকগুলোকে দেখে, বোধহয় ওই সঙ্গের বড় বস্তাটা দেখেই । এমনকি, প্রথম যেবার হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার গল্প শুনলাম বাবার কাছে, মনে মধ্যে ছবিটা সেই ফিরিওয়ালাদেরই একজনের ছিল।

বাড়ির বাগানটা যেন ছিল হারমিওনির সেই ব্যাগটা। সকালে পুজোর ফুল লাগবে তো গাছে হাজারো রকম ফুলের বাহার সারা বছর জুড়ে। টগর , কেতকী, করবী, গন্ধরাজ(ফুল) , লঙ্কাজবা, শুয়োপোকাদের হাউসিং কমপ্লেক্স হওয়া একটা শিউলিগাছও ছিল। শিবরাত্রি তো ধুতরো , আকন্দ, নীলকণ্ঠ সব মজুত। দুপুরে ডাল ভাত তো গাছের থেকে লেবু পেড়ে আনো। কাশি হচ্ছে তো বাসক-তুলসীর রস নিমেষে রেডি । বাড়িওয়ালা এক দিদা তো মাঝে মাঝেই পুঁই , কুমড়ো , লাউ ইত্যাদি গাছ লাগাতেন, রেঁধে দিতেনও সবসময়। তাঁর জাদু ছড়ানো রান্নার কথা আরেকদিন বলব।

বাড়ির পেছনে আবার একটা নিমগাছ , ছাদ থেকে হাত বাড়িয়ে মা পারত নিমপাতা, আর আমি সবজে-হলুদ পাকা নিমফল। নিমফল খেতাম আমি কাকেদের সাথে বসে। একবার তো শরতবাবুর কোন এক ছোটগল্পের থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিমের দাঁতন করার চেষ্টাও করেছিলাম। ব্যাপারগুলো বললে বোধহয় নামী ইংরেজি স্কুলে বন্ধু পাওয়া দুষ্কর হত আমার পক্ষে। অদ্ভুত ব্যাপার, বাড়িটাই যেন শিখিয়ে দিয়েছিল জল হয়ে থাকাটা। কোথায় কেমনভাবে কোন আকারে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে হবে।

তবে খাস ৯৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হয়েও কোনোদিন গ্রামবাংলার বুকের থেকে উঠে আসা কোন গল্পকে মন দিয়ে ছুঁতে অসুবিধে হয়নি। দুটো মাত্র ঘর , তবু আলমারি ঠাসা ছিল ঠাকুরমার ঝুলি থেকে রবীন্দ্র, শরৎ , বঙ্কিম, বিভূতি , শিবরামে। আর চারিদিক জুড়ে ছিল আমার নিজের ওয়াণ্ডারল্যান্ড । এমনি এমনি তো আর বান্ধবীদের স্ল্যামবুকে ফেভারিট বুকের জায়গায় জুলে ভার্ন, কনান ডয়াল এর পাশাপাশি পথের পাঁচালীর নাম জ্বলজ্বল করত না।

বাড়ির উত্তরদিকে ছিল একটা টিনের চালের পোড়োবাড়ি, সাপেদের স্বর্গরাজ্য ছিল জায়গাটা। খুব বেশি মনে নেই, কারণ বড় হওয়ার আগেই ওটা ভেঙে নতুন বাড়ি উঠেছিল। তবু যা মনে আছে, প্রথম ডুমুর গাছ, ফুল, ফল সব দেখেছিলাম ওখানেই। আর ছিল আমার খেয়ে ছুঁড়ে ফেলা বীজের থেকে গজানো একটা বাচ্চা পেঁপেগাছ, কিছু কলাগাছও ছিল বাড়িটার সামনের দিকে। আর ছিল বাড়ির দেওয়াল জুড়ে বট- অশ্বত্থের চারার মাঝেই সদর্পে তরতরিয়ে ওঠা তেলাকুচ আর মানিপ্ল্যাণ্টের ঝাড়। ও , আর একটা কাঞ্চনফুলের গাছ, লাফিয়ে যার পাতা পেড়ে পোঁ করে বাজাতাম আম- আঁটির ভেঁপুর আমার ভার্সন।

বাড়ির পেছনদিকে ছিল আরও একটা বাড়ি যাদের পেয়ারাগাছের অর্ধেক ছায়া পড়ত আমাদের দেওয়ালের এপারে। কাঁচা কষটে পেয়ারার স্বাদ ওখান থেকেই প্রথম পাওয়া।

পাশের বাড়ি থেকে ঝুঁকে পড়া একটা বেলগাছ আর ইউক্যালিপ্তাস ছিল। তাদের পাতা ওপেন ড্রেনটার মুখে লাগাম লাগাতে চাইত চিরকাল। তবে বেল পাকলে কাকের যে কিছু নয়, আর কোকিল যে কাকের বাসা খুঁজে খুঁজে ডিম পাড়ে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবই চাক্ষুশ করার সৌভাগ্য হয়েছিল ওই বেলগাছটার সৌজন্যে।

আরও অনেক গল্প আছে, গাছগুলোর সাথে আমার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার , বা নিমগাছটা কেটে ফেলায় আমার সারাদিনের অসম্ভব কান্না আর সেই প্রথম রাগ করে না খাওয়ার।

তবু এখনও নিজেকে ভাগ্যবান লাগে। বাকি দুনিয়া যখন সবে গপগপাচ্ছে বার্গার, পিৎজা বা হ্যারি পটার, সেই সময়েই আমি চিনেছিলাম থানকুনি পাতা, আম্রপালি , সুপুরিফুলের ইনফ্লোরসেন্সের সেই আচ্ছন্ন করা মায়ের খোলা চুলের মত সুগন্ধটা।

সৌভাগ্য ছিল এতদিন , যে আমার বর্তমান নিজেদের বাসাটিও বেশ একটা গ্রামমাটির গন্ধ নিয়ে ভরে ছিল। চারদিকে পরপর ছটা ফ্ল্যাট উঠে যাওয়ায় আজ হঠাৎ বড় মনকেমন লাগছে।

ও হ্যাঁ, সম্মানীয় পরিচালক মশায়রা, সাউথ কলকাতার এঁদো গলিও “নস্টালজিয়া”-র জন্ম দিতে পারে।


Leave a comment

#প্রথম_বোর্ড_এক্সাম

 
মাধ্যমিকটা ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা, এবং দুর্ঘটনাও বটে। বরাবর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা গোবেচারা ছাত্রী ছিলাম। “মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে” আর কি! কো -এডে পড়তাম, পড়ার থেকে মুখ তোলার ফাঁকটুকুতে ওই বয়সোচিত কিছু গাল রাঙানো মুহূর্তও ছিল ক্লাস সেভেন- এইট থেকে। তবে মাথার ওপর ঝুলিতেছে খাঁড়া, মাধ্যমিক। না জানি সে কত ভয়ঙ্কর এক দত্যি দানো , তবে সে আসার আগে অন্যকিছু করলে বা ভাবলেই নাকি সব শেষ। গান শিখতে কোনকালেই বিশেষ আগ্রহী ছিলাম না, তাই ক্লাস এইটের শেষে হারমোনিয়াম বাক্সবন্দী হয়ে যাওয়াতে বেশ মজা পেয়েছিলাম, তবে আঁকার তুলিগুলো রং শুকনোর আগেই কেড়ে নিয়েছিল মাধ্যমিক, আজও ক্ষমা করিনি …
তা এই কালান্তকারী মধ্যবিত্ত বাঙালী মেডুসাকে আপ্যায়ন করতে আয়োজন নেহাত কম করিনি, বাবার কাছে অঙ্ক, আর বাংলা বাদে বাকি সব টিউটর , দিনের শেষে বাড়ি ফিরে বিছানাটা মনে হত স্বর্গ , আর মায়ের মাথায় বোলানো হাতটা যেন মেডুসার অভিশাপের মাঝে স্বপ্নপরীর জাদুকাঠির ছোঁয়া।
 
ঢোঁক গিলে একশা হয়ে ,পকেটে ঠাকুরের ফুল আর একবুক অতিকষ্টে জড়ো করা বাহারি কনফিডেন্স নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম অচেনা একটা লাস্ট বেঞ্চের কোণে। উতরে গেল ভালোভাবেই সব, এখন চুপি চুপি বলি , অঙ্ক পরীক্ষায় কটা অবজেকটিভ উত্তর মিলিয়েছিলাম পাশের বান্ধবীর সাথে। যদিও কোন এক “দেবদূতে”র কৃপায় ১৫ দিন দু-স্বাগত বাড়তি ছুটি পেলাম, ফিজিকাল সায়েন্সের প্রশ্নপত্র লিক হয়ে যাওয়ায়।
পরীক্ষা শেষোলো। বহুদিন ডিউ থাকা ভেসে বেড়ানোর ছুটিটাও।
 
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ , ১৫ মিনিট বাদে রেজাল্ট, চোখ টিভিতে, মন আগের রাতের ভয়ানক দুঃস্বপ্নে। তা কদিন আগেই স্কুলের শংসাপত্র পেয়েছিলুম যার হাত থেকে, সেই সেদিনের প্রধান অতিথি পর্ষদ সভাপতি মহাশয়ের পাশের হার , মেধা তালিকার ফাঁকেই নেট জানাল ৮৯ % পেয়েছি। অঙ্কে ১০০। বাবার পরিশ্রম সার্থক, মা-র চোখ ছলোছলোর ফাঁকেই স্কুল থেকে প্রিন্সিপালের ফোন , স্কুলে থার্ড নাকি আমি, জরুরি তলব।
তারপর একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল, কোন একটা নিউজ চ্যানেল পাকড়াও করে নিয়ে গেল, কিসব জিজ্ঞেস করল, সারাজীবন স্টেজে উঠলে যার গলা কেঁপে ঘেমেনেয়ে একশা কাণ্ড হয় সে যে কি বলেছিলাম আজও মনে নেই। তবে ওরা বার্গার আর কোক খাইয়েছিল মনে আছে।
 
এখন যখন কলেজের এক একটা পরীক্ষায় পাশ মার্ক তুলতে হিমশিম খেতে হয়, মাধ্যমিকের দিনগুলো এখনও মেডুসার মতই পরিহাস করে। সেই জ্বালাটা আমিই বুঝি, বাবা মা-র আশাহত চোখ গুলো দেখলে এখন, আত্মীয়দের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি, “মেয়েটা পুরো বেকার হয়ে গেল” এই শোনার ভয়ে। ভুলেও মনে আনি না সেই দিন গুলো। ভুলেও না। ভাই বোনেদের পরীক্ষার আগের দিনগুলো তে তাই ফোন তুলে ভালো করে দিস বলি না; বলি, যা হয় হবে ভাবিস , এটা একটা পরীক্ষা শুধু যেটা ঘিরে অপ্রয়োজনীয় হাইপ, জীবনটা আরও অনেক বড়।


Leave a comment

রায়বাবু – পর্ব ১

রায়বাবুকে নিয়ে সকলেই লিখছেন, আমিও লিখি। 😀

রায়বাবু – পর্ব ১

ছোটবেলায় কেবল লাইন , কালার টিভি ছিল না। রবিবার বিকেল ৪ টের সময়ে ডিডি বাংলায় “সা সা নি ধা পা ধা নি”-র সুরে একটা করে সিনেমা হত, বেশিরভাগই পসেনজিত- অঞ্জন চৌধুরী- তাপস-মুনমুন। তবে ছোট থেকে বাবার কল্যাণে মোটামুটি এটা বদ্ধমূল হয়ে গেছিল যে সিনেমা = সত্যজিত তাহার উপরে নাই। তাই ২-৩ মে সহ বছরের যেই কদিন গুগাবাব বা সোনার কেল্লা বা কালেভদ্রে পথের পাঁচালি / অপুর সংসার দেখান হত, সেই দিনগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সেসব রবিবার সকালে কাগজে আজকের সিনেমার কলাম দেখে আগে আগেই স্নান-খাওয়া-ঘুম সেরে রেডি। পরদিন হোম টাস্ক? টেস্ট? ওই কঘণ্টা থোড়াই কেয়ার।
আমাদের বাড়িওয়ালা দের ঘরে কেবল লাইন ছিল। ওই কেবলের একটা নিজস্ব চ্যানেল হত না? যেখানে সকালে স্বামী কেন আসামী আর রাতে শোলে আর গভীর রাতে অকহতব্য ভোজপুরী বিকৃতরুচির সিনেমা দিত? সেই চ্যানেলে গুগাবাবা বা হীরক রাজা হলেই জেঠু হাঁক পারতেন। গোগ্রাসে গিলতাম সেসব, সবিস্ময়ে।

স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে ফিসফিস হত যখন শাহরুখের দেবদাস নিয়ে, বুঝতামই না কি বলছে। আফসোস ও ছিল না তেমন, একটাই, যে অপু বা উদয়ন পণ্ডিত বা মগনলাল বা আচার্যদেব কে নিয়ে কথা বলার লোক পেতুম না বিশেষ।

একবার আমার থেকে খানিক বড় এক মাসি বেড়াতে এসেছে। তদ্দিনে সবে কেবল এসেছে। সেদিন দুপুরে পথের পাঁচালি, আমি তো স্নান করে খেয়ে দেয়ে নাচতে নাচতে টিভি চালাতে এসছি, ওমা, মাসিমনি দেখি স্টার প্লাসে বুঁদ। তার নায়িকার আজকে দ্বিতীয়বার বিয়ে, সিঁদুর পড়ানোর আগের মুহূর্তে নাকি প্রাক্তনের (মৃত ?) প্রবেশ ঘটবে।
সে এক মহাযুদ্ধ রিমোট নিয়ে। অবশেষে মায়ের হস্তক্ষেপে মাসিমনি রাজি হল রিপিট দেখে নেবে বলে। তাই অপুর পাঠশালে যাওয়া থেকে দেখতে পেলুম সেবার।
হরিহর যখন ” এই দ্যাখো না দুগগা মায়ের জন্য এই শাড়িখানা এনেছি” বলে শাড়িটা মেলে ধরল, ওমা, মাসি দেখি ঝরঝর করে কাঁদছে।

শুনলুম বাড়ি গিয়ে মাসি পরপর সব সত্যজিৎ দেখে ফেলেছে কদিনে।

ক্লাস এইটে যখন ভাড়াবাড়ি ছেড়ে এই বাড়িতে আসলুম, মনে হল পুরো সবটাই ওখানে ফেলে এলুম। এত বড় বাড়ি, চারিদিকে খোলামেলা জায়গা, চড়ুই আসে সকালে আর ঘুঘু বাসা করে ডিম পেরেছে চিলেকোঠায়, মন তখনও সিদ্ধান্তে অনড় যে জায়গাটা খুব বাজে।

পাশের ঝা চকচকে পাড়ার ঠিক মধ্যিখানে একচিলতে বেমানান বাশবাগান । কৌতূহল হল।
খোঁজ নিয়ে শুনলাম এই অঞ্চল আগে পুরোই বাঁশের ঝাড় ছিল, আর ঠিক ওই মধ্যিখানের জায়গাটুকুতে গুপী বাঘা তিন বর পেয়েছিল।

আরও শুনলাম, আমার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে বোড়াল নিশ্চিন্দিপুর।

আর আমাকে পায় কে?

পুনশ্চ ঃ মহানুভব প্রোমোটারের দাক্ষিন্যে ওই একচিলতে জায়গাটুকুতে আজ সুদৃশ্য বহুতল। আমি সেই এপার্টমেন্টে পড়াতেও যাই।


Leave a comment

দু-মুঠো দিনের ঝড়

“ধুর ,  তোর কাজকর্ম নেই নাকি শালা আলবাল হ্যাজাচ্ছিস বসে বসে? দোতলার ফিজিক্সের স্টাফরুমে ৫ টা কফি দিয়ে আয়।  ’’ তপনদা বহুদিন আছে এই কলেজে। ক্যান্টিনটার সর্বেসর্বা মানে সবাই ওকে। ওর ওপরে কথা বলার সাহস নেই শীর্ষেন্দুর। সে নতুন জয়েন করেছে।

সব পিতৃস্থানীয় কলিগদের মধ্যে একমাত্র খানিকটা সমবয়সী বিরজু। ওড়িশার ছেলে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলে। ওর সাথে কথা বলে সুখ নেই। আর বাকিদের সাথে বাজারদর বা কলেজের নতুন ব্যাচের ডবকা মেয়েদের নিয়ে আলোচনায় ওর কোন ভূমিকা থাকতে পারে বলে ভাবেওনি শীর্ষেন্দু। তবু আজকে একটা বর্ণনা শুনে এগিয়ে গিয়ে একটু ঔৎসুক্য প্রকাশ করতে গেছিল , এই ঝাড় জুটল।

মনটা তেতো হয়ে গেল। ট্রে টা হাতে তুলে নিয়েও বেরোতে ইচ্ছে করছিল না, কারণ জানে এখন ওই বর্ণনাকে  কিভাবে কুৎসিত অশ্লীলতার চটকদার মোড়কে ভরে পরিবেশন করা হবে। সবাই দেঁতো হাসি হাসবে; বিরজুও। এইসময়ে ও বাংলা বুঝতে একটুও ঠোকর খাবে না। শরীরটা এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে ছটফট করতে লাগলো শীর্ষেন্দুর।

কারখানার মেশিনে ডানহাত কাটা, ছাঁটাই হওয়া একটা পঙ্গু বাবা, রংচটা চুড়িদারের ক্লাস টেনের একটা বোন, আর দর্জির দোকানের ফাইফরমাশে বিধ্বস্ত একটা মা। বাড়িভাড়া আর ঋণশোধের জিজ্ঞাসাচিহ্নময় নোনা ধরা দেওয়ালে তেলচিটে লক্ষ্মীপটের গায়ে অভিমানের ধুলো; ধুলোতে মায়ের মাঝরাতের কাশি যখন ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে রেসোনান্ট হয়ে যায়, ওষুধ আর জলটা এগিয়ে দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়তে এখন আর অসুবিধে হয়না শীর্ষেন্দুর।

লাউশাক , চারাপোনার সংসারে কবিতা লেখা যে চলে না বুঝতে সময় লাগেনি সদ্য উচমাধ্যমিকের গণ্ডি ডিঙ্গনো শীর্ষর।ছুঁচ-সুতো-কামিজের মাপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন মায়ের হাতে  বালতি – ঝাড়ু ধরিয়ে দেওয়া হল, তার কদিন পরে শীর্ষেন্দু এই ক্যান্টিনটায় ঢুকল । সকালে কলেজ যাচ্ছি বলে বেরনোর সময়ে মনের সামনে ইংলিশ অনার্সের অ্যাডমিশনের লিস্টটা  বিদ্রুপ করে। সকালে ক্যান্টিন, বিকেল থেকে রাত অবধি টিউশনি , বোনকে নিয়ে বাড়ি ফেরা।

নন্দিতাকে ভালো লাগত। একবার সাহস করে একটা কবিতামাখা চিঠিও পৌঁছেছিল গোলাপিরঙা তেতলা বাড়ির কোনের ঘরটায়। সেটার আর হদিশ বা প্রত্যুত্তর কোনটাই পাওয়া যায়নি।বাবার অ্যাকসিডেন্টটার খবরটা আসার পর “একদিন দেখিয়ে দেব বড় চাকরি করে” গুলো  অচিনপুরের মর্গে ফ্যাকাশে হয়ে শুয়ে থাকল, কড়িকাঠের দিকে নির্বাক অচলদৃষ্টে।

 

খালি ট্রে টা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামার সময়ে ঘটলো ব্যাপারটা। বাঁক ঘুরতেই সোজা মুখোমুখি। কাল একটা নীল টপ ছিল, সামনের প্রজাপতিটায় টম্যাটো সস লেগে গেছিল, কুঞ্চিত ভ্রু শীর্ষেন্দুর কাছে টিস্যু চেয়েছিল, আরেক হাতে ধরা ছিল “ফার ফ্রম দা ম্যাডিং ক্রাউড” । আজ একটা বেগুনি কুর্তি, তবে চুলটা খোলা, দুদ্দারিয়ে উপরে উঠছিল, তখনই এই কাণ্ড।

ভেবলে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রাগ হতে গিয়েও হেসে ফেলল মেয়েটা। তড়াক করে সরে যেতে গিয়ে শীর্ষেন্দুর  “এক্সকিউজ মি”-র প্রতীক্ষা করা কানে একটা অচেনা শব্দযুগল প্রবিষ্ট হল।

“লাগেনি তো?’’

 

রবি ঠাকুরের গল্পে পড়েছিল “কর্ণ দিয়া মরমে পশিল গো” ব্যাপারটা।

 

আজ রাতে ঘুম নেই শীর্ষেন্দুর চোখে ।

মা অনেকক্ষণ ধরে কাশছে, তবে সেটা কারণ নয়। সারাদিনের ক্লান্তি , তবু কিছুতেই ঘুম আসছে না। পুরনো ক্যাম্বিস খাট টায় এদিক ওদিক করতে গেলেই মৃত্যুযাত্রীর শেষ আর্তনাদের মতো শোনায়। বিরক্ত হয়ে উঠে বেড়ালপায়ে হেঁটে দরজাটা খুলে বাইরে বেরোয় শীর্ষেন্দু ।

মায়ের একসময়ের শখের একটেরে বাগানের কঙ্কালটুকু পড়ে আছে। ভাঙা টবের দেহাবশেষের মাঝে একটুকরো স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ালো ও। বা হাতের চেটো দিয়ে চোখটা আলতো করে রগড়ে নিতে নিতে শীর্ষেন্দু দেখল ওর না ফোটা রেশমগুটি গুলো ধীরে ধীরে নীল বরফে ঢেকে যাচ্ছে,  নীল আকাশে ওড়া বেগুনি প্রজাপতি হওয়ার আগেই।

 

বোনের গায়ে ছেঁড়া রঙের স্নেহমাখা অনাভিজাত্য হালকা করে টেনে দিয়ে বিনা দীর্ঘশ্বাসে ঘুমিয়ে পড়ল শীর্ষেন্দু।

 

তিন মাস হল এই ক্যান্টিনে। মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল অক্টোবরের এক একেঘেয়ে সকালে। ছুটি পড়ার আগের দিন। অর্ধেক কলেজের ইন্টারনালের শেষ দিন। চা আর কফির ডিমান্ড সবচেয়ে বেশি হয় এসব দিনে। সকলেরই চেহারায় খুশি মেশানো স্ট্রেস। এর মধ্যে শীর্ষেন্দু দেখতে পেল একটা প্রজাপতি উড়ে উড়ে এলো, ছটফটে চুলে বেমানান ঋতুর গন্ধ। এসে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস  বলল, শীর্ষেন্দু বিভ্রান্তের মত এগিয়ে দিল। মেয়েটা মিষ্টি হেসে “থ্যাংকস” জানিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশে গেল।

সেদিন থেকে শুরু। সারা পুজোর ছুটি শীর্ষেন্দু গোলাপি-নীল একটা ঘোরের মধ্যে  কাটাল। একটা টিউশনি গেল, ছেলেটা সেবারও ক্লাস ৮ এর ষাণ্মাসিকে বাংলায় ফেল করল বলে। নতুন পাওয়া চাকরি আর টিউশানির টাকা জমিয়ে মা-র একটা ছাপাশাড়ি , বোনের কিছু সহায়িকা বইয়ের পরেও যেটুকু বেঁচে ছিল, সেই দিয়ে একদিন  কফিহাউসে কফি খেল, পাইরেটেড দুটো ইংরেজি গল্পবই কিনল, আর কলেজ স্কোয়ারের বিক্ষিপ্ত প্যান্ডেলের আড়ালে বসে থাকা যুগলদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল।  তারপর দিন রাতে মোমবাতি জ্বেলে ফের খুলল একটা হালকা হলদে পাতার লাল ডায়েরি। লিপিবদ্ধ হল ছড়িয়ে থাকা কথারা। একযুগ পর। তারপরের দিনও। তারপরের দিনও।

 

 

ঠিক ২৭ দিন ১১ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড বাদে ফের ঝড়ের আগের সন্ধ্যাতারার দেখা পেল  শীর্ষেন্দু। কলেজ খোলার পর প্রথম দুদিন আসেনি। তারপর এল; একদল বন্ধুর সাথে খিলখিলিয়ে। উৎসুক হয়ে বসেছিল শীর্ষেন্দু, একটা কোল্ড ড্রিংকস এগিয়ে দেবে বলে, কিন্তু সেদিন আর আসল না সে নিজে। আরেকজন কে পাঠালো তার খাবারটা নিয়ে যেতে।

তারপর আবার কদিন দেখা নেই। যেদিন এলো ৩ মিনিটের জন্য, সেদিন শীর্ষেন্দু বোকার মত মজে ছিল কোহলির ইনসাইড আউটে। গলার আওয়াজ শুনে যখন চমকে ফিরল, ততক্ষণে সে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বাচ্চা ছেলের পাড়ার ক্রিকেটে ব্যাট না পাওয়ার ঠোঁটফোলানো অভিমান নিয়ে সারদিন গুম হয়ে থাকল ও।

ক্লাস ৫ এর পুচকে একটা মেয়ে, ও বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস , ভূগোল পড়ায়। রোজকার মত মেয়েটার দাদু দরজা খুলল, মুখ আজ থমথমে। মাথা ঘামালো না শীর্ষেন্দু বিশেষ। ভেতরে ঢুকে দেখল মেয়ের বাবা, মা সকলে টেবিল জুড়ে আষাঢ়ে মেঘ হয়ে বসে। মেয়ে ধারেকাছে নেই।

“বোসো।’’ মেয়ের মা কড়া গলায় নির্দেশ দিল।

খানিকক্ষণ সবাই চুপ, শীর্ষেন্দু আঁচ টা পেয়েও পাচ্ছে না যেন।

“ এই ছেলে তুমি আসলে কি করো খুলে বল তো?” দাদু আর সামলাতে পারলেন না।

“আহ বাবা, আপনি চুপ করুন।’’ মেয়ের মা ধমকে থামিয়ে দেয়।

“শোনো, তুমি কোন কলেজে পড়ো যেন বলেছিলে?

“ চারুচন্দ্র কলেজ, ইংলিশ অনার্স।’’  আমতা আমতা করে বলে শীর্ষেন্দু।

“ কই প্রমাণ দেখাও, আইডি কার্ড কোথায়? ’’

“এখন তো সঙ্গে নেই। ’’ বেশ ঘাড় উঁচু করেই বলে ও।

“ বেরিয়ে যাও এক্ষুনি। একটা কলেজের ক্যান্টিনে কাজ করা ছেলে আমার নাতনিকে পড়াবে?  তাও আবার মিথ্যে পরিচয় দিয়ে? দাদুর কথাগুলোর নীরব সায় দেয় গোটা ঘরটা। মাথা হেঁট করে ঝাপসা চোখে বেরিয়ে যায় শীর্ষেন্দু। টুকরো টুকরো কথা তখনও এসে বিঁধছে তীক্ষ্ণ বরফকুচির মত।

“ভাগ্যিস সেদিন নীল এসে ছবিটা দেখে বলল”

“হ্যাঁ, তোমার মেয়ে তো আবার এইরকম একটা ছেলেকে ফেভারিট টিচার বলে নোটবুকে তার ছবি লাগিয়েছে।“

“কিরকম ডেস্পারেট ভাবতে পারছ? এতদিন এভাবে মিথ্যে বলে চালিয়ে দিল?”……

যেমন মায়ের সাথে ৯০ এর দশকের বাংলা সিনেমায় দেখত ছোটবেলায় হা করে, যেমন বড়বেলায় সত্যজিৎ,  মৃণাল সেন চিনে হাসত এসব ভেবে, তেমনি একটা কিছু যে বাস্তবেও ঘটতে পারে, এবং তার নিজের সাথেই, ধারণা ছিল না শীর্ষেন্দুর। আজ হঠাৎ ওই অতিরঞ্জিত , ঝাঁঝালো আবেগ আবহপূর্ণ ছায়াছবির বেনামি পরিচালকের প্রতি এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা জেগে উঠল।

 

 

“এই দাদা, আবার রাতে ঘুমনো বন্ধ করেছিস না? ইশ চোখগুলো কি লাল হয়ে আছে। কি হয়েছে বল তো তোর? কলেজে কিছু হয়েছে? ওই তপনদা না কে লোকটা, আবার কিছু বলেছে রে? দাদা, ওই দাদা শুনছিস?”

“ উফ চুপ করবি একটু তুই? ভালো করে পড় শুধু, সামনে টেস্ট। বাকি কিছু নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না।’’

দাদার ঝাড় খেয়ে চুপ করে যায় বোন।

আলু-বেগুন-ঝিঙ্গের চচ্চড়ি দিয়ে রুটি টুকরোটা মুখে পুরে রান্নাঘরের কালিঝুল মাখা শিকভাঙ্গা জানলাটা দিয়ে বাইরে তাকাল শীর্ষেন্দু। আচ্ছা, মেয়েটা এখন কি করছে? হয়তো সাদার ওপর লাল ফুটফুট চাদরে উপুড় হয়ে শুয়ে হয়তো উপন্যাস পড়ছে। নীল কুর্তির বেখেয়ালে বেরিয়ে পড়েছে ব্রা এর একটা ফিতে। শুয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে হয়ত উঠে বসল একটু , তারপর পাশে হাত বাড়িয়ে গ্লাসের কোল্ড ড্রিংকে চুমুক দিতে দিতে ফের ডুবে গেল ভিড়ের গভীরে।

 

“কি রে, খা!” মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরল শীর্ষেন্দুর।

মা একসময়ে অনেক বই পড়ত, বাড়িতে রোজ খবরের কাগজ কিনে আনত বাবা, আর মা-র জন্য কত রংবেরঙের ম্যাগাজিন। মা-ই নাম রেখেছিল শীর্ষেন্দু। প্রিয় লেখকের নামে।

 

পরদিন কি যে হল হঠাৎ,  একবার একঝলক লাঞ্চ ব্রেকের ভিড়ের মাঝে দেখেছিল ওই ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া খোলা চুল, উঁচু করে একটা লম্বা কাঁটা দিয়ে সামলে রাখা। তারপর ভুল বকতে শুরু করল শীর্ষেন্দু, তাও আবার বিরজুর কাছে। বোনের কথা, নন্দিতার কথা সব । তখনই তপনদার  ঝাড়টা খেল ।

আর তারপরেই ঘটল সেই ছায়াপথে নীহারিকা ধাক্কা খাওয়ার সময় থেমে যাওয়া ঘটনাটা।

 

সেদিন রাতে শীর্ষেন্দু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সবকিছু ঝেড়ে ফেলার, ছুঁড়ে ছিঁড়ে ফেলার। তার জীবন অন্য ধাতুতে গড়া  হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই, তার মতামত নেওয়ার অপেক্ষা রাখেনি। তাই পরদিন একজন ঝা চকচকে সুপুরুষ ছেলের হাত ধরে যখন সে ক্যান্টিনে ঢুকল, বা যখন তারা এক গ্লাস থেকেই কোল্ড ড্রিংক খেল, শীর্ষেন্দু থরথর করে কাঁপতে গিয়েও কাঁপল না। এই বরফের ঝড় তাকে হারাতে পারবে না, ভরসা আছে।

 

আর আছে বলেই পরের দিন , তারপরের দিন আর তারপর আরও অনেক অনেক গুলো দিন চোখের সামনে ভোরবেলার এক উত্তাল ঝড়ের ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে হতে বদ্ধ একমুঠো নিঃশ্বাস হয়ে যেতে দেখেও সে চুপ থাকল, নিশ্চল , নির্জীব।

 

বোন ততদিনে মাধ্যমিক পাশ করেছে। সায়েন্স নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু টিচার নিতে হবে সব সাবজেক্টে। তাই আর্টস।

নতুন স্কুলে যাচ্ছে বোন। সকালে স্টেশনে যাওয়ার পথে বোনকে পৌঁছে দিয়ে যায় স্কুলে;  পার্টি অফিসের পাশের মদের ঠেকটার কতগুলো ছেলে বেশ কয়েকদিন উত্যক্ত করেছে ওকে। কারও সাহস নেই গলা বড় করে প্রতিবাদ করবে। পরের বাড়ির মেয়ের হয়ে বলতে গিয়ে কেউই চায় না নিজের অন্দরমহলে বিপদ ডেকে আনতে। শীর্ষেন্দু জানে ওরা পাঁচজন ঘিরে ধরলে ও কিচ্ছু করতে পারবে না। ওর বোনও জানে। তবু একটা ভাসা ভাসা আশা নিয়েই বেঁচে থাকা। সবটা সময়।

মিথ্যে মিথ্যে তাসের ঘর সাজিয়েই তো মানুষ বেঁচে থাকে, যতই সে ভাবুক সে বাস্তবের শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে আছে।

 

বাবা বহুদিন ধরেই শয্যাশায়ী। ইদানিং একেবারেই অচল। বেডপ্যান কেনার আগে অবধি মাকেই সব পরিষ্কার করতে হত। ওষুধের খরচ হুহু করে বাড়ছে।  এর মধ্যে বাড়িওয়ালা আবার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।  মায়ের চেহারার দিকে তাকানো যায় না। সেদিন রাতেই কাশতে কাশতে রক্ত পড়ল। শীর্ষেন্দুর চোখ ফেটে জল আসে, বোনকে দেখে শিখেছে মুখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ঠায়।

শীর্ষেন্দুও নতুন কাজ  নিয়েছে আরেকটা । টিউশন মাত্র দুটো টিকে আছে। তাই কলেজ থেকে শিয়ালদহ হয়ে ফেরার পথে সান্ধ্য খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন কেনে। তারপর ওই দু ঘণ্টা ফেরি। মাঝে মাঝে বেঁচে যাওয়া ম্যাগাজিনগুলো সযত্নে এনে মায়ের বিছানার কোণে রেখে দেয়। মা চোখ বন্ধ করে হাসে ওর দিকে তাকিয়ে।

 

 

বাবা হাসপাতালে ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। রোজ মা গিয়ে দেখে আসত, খাইয়ে আসত রান্না করে নিয়ে। শীর্ষেন্দু ৩ দিন গেছিল, আর বোন একদিনই। শেষের দিন ওরা তিনজনেই ছিল, শীর্ষ দেখল মায়ের হাতটা চেপে ধরে বাবার হাত টা ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ল, কিছু একটা বলতে গিয়ে মুখটা থমকে গেল, খানিকক্ষণ  বিভ্রান্তির পরে মায়ের বুকফাটানো কান্না।

 

শীর্ষেন্দু কিন্তু কাঁদল না, বরং কাঁদতে চাইল কিন্তু পারল না। কিছুতেই না। অথচ ও পাথর হয়ে যায়নি, সচল । ও নিজেও অবাক হয়ে গেল , বাবাকে কি অনেকদিন আগেই হারিয়েছিল ও? মনে পড়ে না শেষ কবে বাবার পাশে বসে কথা বলেছে, বাবা টার শীর্ণ হাত ওর মাথায় বুলিয়ে দিয়েছে।

 

দুদিনের ক্লান্তি আর অবিন্যস্ত চুল, একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকল শীর্ষেন্দু। তপনদা বসতে দিল একটা বেঞ্চ টেনে। বিরজু চা-জল এনে দিল। শীর্ষেন্দুর অসহ্য লাগছে এসব। ও কাজ করতে এসেছে, ও জানে একদিনের টাকা কাটা যাওয়ার দাম কিভাবে চোকাতে হয়।

“তপনদা আমাকে কাজ করতে দাও” সংক্ষেপে বলে ও।

“বস না একটু, বুঝি রে তোর কষ্টটা । আমার বুড়ো বাপটাও তো, আজ আছে কাল নেই অবস্থা।’’ তপনদা আলগা আবেগ এনে গলা ভারী করে।

বিরক্ত হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। রোজকার কমলা হলুদ সূর্যাস্ত । তার মাঝেই হাতড়ে বেড়ায় একটা মানে, পারপাস।

“চাবিটা রইল, বুঝলি তো? বেরনোর সময়ে বন্ধ করে জমা দিয়ে যাস। আজ আবার মঙ্গলবার কিনা, একটু পুজো –আচ্চা থাকে, জানিসই তো…হে হে।’’ চোখ টিপে একটা জঘন্য হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায় তপনদা, পেছন পেছন শিস দিতে দিতে বিরজু।

শীর্ষেন্দু একা বসে থাকে একটা টেবিলে। কলেজে বেশি কেউ নেই এখন, ক্যান্টিন তো ফাঁকাই।

চাবির গোছ টা নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছিল । একটা দূর, অনেক দূর  থেকে ভেসে আসা, মহাশূন্যের ডাকে ঘোর ভাঙল।

“ কফি হবে?”

টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আজ। পরনে সেই নীল প্রজাপতি, যেটাকে স্বপ্নে ডানা মেলে উড়তে দেখে শীর্ষেন্দু।

তড়িঘড়ি উঠে কফি মেশিন থেকে এক কাপ কফি বানায়। এগিয়ে দেয় অচেনা বিষণ্ণ এক মুখের দিকে ।

মেয়েটা কিন্তু বেরিয়ে যায় না। কফি নিয়ে বসে সেই টেবিলটায় যেটায় এতক্ষণ শীর্ষেন্দু বসেছিল। ওর চাবিটা ওখানে এখনো। দূর থেকে দেখতে থাকে একজোড়া মনমরা চোখ কমলা হলুদ সূর্যাস্ত দেখছে। ও ও হয়তো পারপাস হাতড়ে ফিরছে।

চাবিটা আনতে যায় সন্তর্পণে, নিজের আধখাওয়া চায়ের কাপ টাও ওখানে এখনও, পরিষ্কার করতে হবে। সামনে গিয়ে একঝলক তাকাতে যায় আড়চোখে, ধরা পড়ে যায় ।

“বোসো” অচিনপুরের ঈশান কোণে বহুদিন বাদে কালো মেঘের আভাস বয়ে নিয়ে আসে শব্দটা ।

শীর্ষেন্দু বসে।

তারপর আর সামলাতে পারে না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে অবুঝের মত। এতদিনের জমানো বৃষ্টিরা কালো মেঘের সামনে অভিমান ফেটে বেরোয়। সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেতে যেতে বোঝে ওর হাতের ওপর ভোরের ঝড়ের ঠাণ্ডা স্পর্শ।

চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামে, আর ঝড়। অনেক ভোরের স্বপ্ন ভেঙে শীর্ষেন্দু উঠে বসে, জানলার পাশে দাঁড়ায়, না আজ আর দীর্ঘশ্বাস নয়, আজ সত্যি নেমেছে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি।

 


Leave a comment

শ্রী-” ইলিশের গন্ধটাই কেমন যেন। বড্ড আঁশটে । ভালো লাগে না একদম। ”

হবু শ্রীমতী -“সে কি? লজ্জা করে না বাঙালের সামনে বলতে? ঘটিগুলো আর খাওয়া শিখলো কই? ”

-” ইয়া ইয়া সাইজের গলদা চিংড়ির মালাইকারি, হু হু বাবা, আমি রান্না করে খাওয়াব দেখবে, কোথায় লাগে তার পাশে ইলিশ?”

-(আমতা আমতা) ” চিংড়ি ? হ্যাঁ চিংড়ি ভালো বটে। শুনেছি।”

-” কি হল? ”

– ” অ্যালার্জি ”

-“…………”

– “…………”

– ” আচ্ছা রোববার করে কষা মাংসই হবে তাহলে।”


Leave a comment

নাম দিয়েছিলে একটা।

গভীর কোন আবেগের নিষ্পাপ ছোট্ট আত্মপ্রকাশ।

তখনও বৃষ্টি ঝরা পাতাদের কলরব থামেনি।

তখনও শ্যাওলাধরা হৃদয়ে গোপন হাতছানির অনুরণন।

 

বরফগলা জলকণাগুলো অনধিকার স্বপ্ন হয়ে অনুপ্রবেশ করেছিল তোমার দশটা–পাঁচটার রোজনামচাতে।

তার একটা নগ্ন প্রতিচ্ছবি দেখেছিলুম আমার আয়নাতে।

অজানা রোমাঞ্চ, অচেনা পদশব্দের উন্মুক্ত স্পন্দন তখন আমার শিরায় শিরায়।

তবুও সব উপেক্ষা করেছিলুম নির্দ্বিধায়ে,

একটা স্মৃতির প্রেতাত্মার কালো ছায়া দেখে;

রাতের বালিশে মুখ গুঁজে ভেবেছিলুম পুরনো অ্যালবামটা আঁকড়ে ধরেই লিখবো বাকিটা।

 

আজ এ কোন মেঘভাঙা জলোচ্ছ্বাস?

ভেসে গেল হঠাৎ সব কঠিন মরণপণের বিস্তৃত কাঠামোগুলো।

ছিঁড়ে পড়ল  সব আলোছায়া পর্দারা।

 

আজ একমুহূর্তের জন্য আমি বাঁচলাম।

বাঁচলাম শুধু সেইক্ষণকে আপন করে।

তোমার বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধে ডুবে।