ভুল রাস্তার মোড়ে


Leave a comment

ভেজা মাটির গন্ধ

 

“আমি কোনদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি কারও সাথে কাটাইনি জানিস ? ’’ প্রথম পরিচয় ফেসবুকে, প্রথম দেখা ছিল ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে ; জিওলজি গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে নির্ঝরকে বলেছিল মেয়েটা।

নির্ঝর উত্তর দেয়নি, হালকা হেসে আলতো করে ছুঁয়েছিল কাঁধের কোণ, আর সেই পাগল করা নেশা নেশা মাটির গন্ধটা পেয়েছিল প্রথমবার, ওর চুলের থেকে। মাটির গন্ধ জানে নির্ঝর, কিন্তু এরকম মাতাল করা মাটির গন্ধ কোনদিন পায়নি ।

মেয়েটা স্নিগ্ধ হেসেছিল।

জুনের ভিজে শার্টের দুপুরবেলাতেও একপলক বরফপাত।

 

“এইটে আমার সবচেয়ে আপন গান ’’ , বলে শ্রাবণের ধারার মতো গান গেয়েছিল মেয়েটা। নিখুঁত গায় না, তবে অসম্ভব রকমের একটা মেঠো গন্ধ পেয়েছিল নির্ঝর।

“ তোর নামটা কি সুন্দর, চুপ করে  ভিজতে ইচ্ছে করে।’’ তখনও বর্ষা আসেনি মহানগরীতে, তবু মেয়েটা চোখ বুজে  দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রিন্সেপ ঘাটের থামটায় ভর দিয়ে। বড় বড় নিঃস্পন্দ একরাশ চোখের পাতায় সেদিন জিওস্মিনের গন্ধ মেখে মেঘ ঘনিয়ে এসছিল। নির্ঝর অবুঝের মতন ছুঁয়ে ফেলেছিল , ভেজা মাটির ঠোঁট দিয়ে, প্রথমবার।  মেয়েটাও।

মেয়েটা চোখ খুলল যখন…… কলকাতায় তখন রিকশাওয়ালা পলিথিনের ছাউনি টানছে , কলেজ স্ট্রীটের ফুটপাথে অপ্রস্তুত তড়িঘড়ি, উত্তর কলকাতার ছাদে শুকনো কাপড়ের তোড়জোড়ের মাঝে একরাশ স্বস্তি, ময়দানে ফুটবল পায়ে উল্লাস , স্কুলের  জানলায় আনমনা প্রথম প্রেম  …  প্রথম বৃষ্টির কলকাতা।

 

তারপর ছিল নতুন সবুজ ঘাসের ওপর খবরের কাগজ আর খালি পা , ভিক্টোরিয়াকে সাক্ষী রেখে অলিখিত  আলিঙ্গন।  উন্নাসিক মেঘের চাদরকে উপেক্ষা করে ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে বসে ছিল নির্ঝর। এককোণে তখন ধুলো আর ঝরা পাতার ষড়যন্ত্র , বিদ্যুতের লুকোচুরি । ঝড়টা আছড়ে পড়তেই মেয়েটা মুখ লুকিয়েছিল নির্ঝরের বুকে। নির্ঝর আবারও হার মেনেছিল ওই মেঘ কালো চোখের পাতার কাছে।

প্রথমবার কালবৈশাখী অভিসার । বর্ষার দিব্যি রেখে।

 

একদিন ছিল মনখারাপ ।

“ কলকাতা আর বর্ষা, শব্দ দুটো মিলিয়ে দিলে কারও কারও মনে আসে জমা জল, ম্যালেরিয়া আর ইলিশ মাছ। আবার কারও মনে হয় ঝাপসা কাঁচ , মেঘলা ছুটি , আলগা ঝড় । তুই কোন ক্যাটাগরি?’’ সিগারেটের ধোঁয়াটা  নির্ঝরের নাগালের বাইরে ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিল মেয়েটা।

নির্ঝর  হেসেছিল শুধু, “তুই? ’’

“ কলকাতা আর বর্ষা মানেই  মনখারাপ । ’’ মেয়েটা আনমনে আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বলেছিল, নিরুত্তাপ ভাবে যোগ করেছিল , “চল আজ তোর বাড়ি যাব। ’’

সেদিন চিলেকোঠায় ধুলো আর নস্টালজিয়ার আবরন, পুরনো তক্তপোশ আর ছেঁড়া তোষকের বৈরিতা । খোলা জানলার অনিয়মিত বৃষ্টির ছাঁট, তার মাঝে মিশে গিয়েছিল ঝরনা আর বৃষ্টি আর মেঠো আর নেশা নেশা আর মনখারাপের গন্ধ। নির্ঝর সেই প্রথম বুঝেছিল ওর প্রিয় ঋতু বর্ষা, স্কুলের খাতায় লেখা শরৎ নয়।

 

“আজ অফিস যাস না, কলেজ স্ট্রিট যাব চল। ’’ মেয়েটা বোধহয় খবর দেখত না।

“ আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা। জানিয়েছেন আবহাওয়া দফতর প্রধান ……” যান্ত্রিক সুরে দূরদর্শনে খবর শুনেছিল নির্ঝর। গত ভোটের পর থেকে প্রতিযোগী দুই সংবাদ চ্যানেলের দ্বৈরথে বিতৃষ্ণ হয়ে বাবা এই পন্থা নিয়েছেন।

সেদিন কলেজ স্ট্রিট ভেসে গিয়েছিল। মহাপ্লাবনের প্রাকমুহূর্তে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল মনখারাপি মেয়েটা, এককোমর কালো জল ঠেলতে ঠেলতে । নির্ঝরের মুখে তখন দিওয়ালীর প্রথম জ্বলা প্রদীপ।

সেদিন শহরের উগরে দেওয়া নৈঃশব্দ আর নিষ্প্রাণতা জলে ভেসে হেডলাইন বানিয়েছিল পরদিন। কাকভিজে দুটো প্রাণী পরিত্যক্ত বেঞ্চের কোটরে বসে সংসার সাজিয়েছিল…… কুর্তি – জিন্‌স , dunhill, টেরাকোটা কানের দুল আর ২-৩-৫ মাসের সম্পর্ক দিয়ে defined একটা মেয়ে প্রথমবার মেয়ে হলে কি নাম রাখব আবৃত্তির ফাঁকে কক্সবাজারের সূর্যাস্ত হয়েছিল, নির্ঝর মনে মনে অ্যালবামের পাতা ওলটায় আজও ।

না, এটা ঠাই পায়নি কোন লেখকের এন্ডিং লাইনের ভেতরে।

তারপর ছিল শিয়ালদা ফুটপাথ , চিংড়ির আর টম্যাটোর চপ, দুধ চা আর মেঘপিওনের লুকিয়ে পড়া চিঠির  দিস্তা।

আরও একটা বৃষ্টি হয়েছিল কুমোরটুলির একটা রংচটা সবুজ পলিথিনের তলায়। ছাতা নেয়নি সেদিন

কেউই । নির্ঝর ওই আঁধার কালো চাহনির সামনে DSLR বের করার সাহস পায়নি। ওরা কথা বলেছিল, সোমেন পাল, ভগীরথ পাল, কাঁচাপাকা দাঁড়ির গোপাল ভটচাজের সাথে। মেয়েটা একটা রুপোলী জরির মুকুটের মধ্যে চুমকি বসিয়েছিল একটা বাচ্চা ছেলের সাথে । তারপর একটা ছেলেবেলার বৃষ্টি নেমেছিল, গ্রামের বাড়ি ,খালি পা, ধানের খেত , খড়ের চালের লাউগাছ পেরিয়ে। স্মৃতিবিদ্ধ নির্ঝরের সম্বিত ফিরেছিল পুজোর গন্ধ আর মাটির গন্ধ মিশে যাওয়ায়, ওর কাঁধে রাখা মাথায় মাথা ঠেকিয়ে।

 

শেষ বৃষ্টিটা হয়েছিল অচিনপুরে । মেয়েটা সেদিন চুল খুলে এসেছিল, শ্যাওলা রঙের একটা শাড়ি। একটা বেপাড়ার বাসে জোর করে উঠিয়েছিল ঘন ঘন ঘড়ি দেখা নির্ঝরকে। তারপর আবার নেমে গিয়েছিল অচেনা  শহরতলিতে। একটা নাম না জানা মাঠ , তার পাশে সুখ – দুঃখের  দীঘি। কিচিরমিচির নিস্তব্ধতায়  ডুবে গেছিল রোজনামচা । তারপর এবছরের শেষ বৃষ্টি হয়েছিল চরাচর জুড়ে । মুগ্ধ দুচোখ জুড়ে। দুর্গার শেষ ভেজা বৃষ্টির মত নিষ্পাপ বর্ষণধারা আর ভেজা মাটির গন্ধ।

 

শরৎ , হেমন্ত , শীত । ফিকে হতে হতে প্যালেটের রংগুলো সব একে একে মুছে ধুসর হচ্ছে। গন্ধটা যেন দূরে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। এপারের না বলা ঝোড়ো হাওয়ারা ওপারের এক অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠা কাঁচের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে বিঁধছে কনকনে নিষ্ঠুর শীতের হাওয়া হয়ে।  উপন্যাসটা অনিয়মিত হয়ে হয়ে ছোটগল্পের মর্যাদাটুকুও যেন হারাতে চাইছে, নির্ঝরের মনে হল।

ডিসেম্বরে মেয়েটা এসএমএস করল , জন্মদিনের আগের রাতে। নির্ঝর তখনও ওর নিজের হাতে বানানো ক্যালেন্ডারটা রিবন আর জিজ্ঞাসাচিহ্ন দিয়ে বাঁধতে ব্যস্ত।

“ নির্ঝর আই ডোন্ট থিঙ্ক ইটস ওয়ারকিং আউট এনি মোর। সরি। ভালো থাকিস। ’’

 

অপ্রত্যাশিত ছিল না হয়তো। তবু লাগল । খুব জোর লেগেছিল।

ফোন তোলেনি মেয়েটা।

তারপর কখনও মাতাল হয়নি নির্ঝর আর ।

তারপর যেমন হয়।

পিঙ্ক ফ্লয়েড, ইনসোমনিয়া, অ্যান্টি- ডিপ্রেসেন্ট।

একটা হিমবাহর তলায় চাপা পড়ার আগের মুহূর্ত অবধি বহু অবান্তর অলীক আশার ইতস্তত বিচ্ছুরন।

তারপর একদিন বাতাসের কানে কান না পেতেও শুনতে পেল নির্ঝর অদৃশ্য আলোর রোশনাই, আর নতুন খাতায় লেখার মতো একঝাক খুশি; মেয়েটার লাল শাড়ি আর পানপাতায় ঢাকা মুখ, আর তার আড়ালে মেঘ কালো আঁধার কালো চোখ ।

 

হিমবাহ আর সারনেম নিয়ে নির্ঝর পাড়ি জমালো নিরুদ্দেশে। দশটা- সাতটা, ভিড় মেট্রো, রোববারের বাজার আর বাবার ওষুধের মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে ওঠা বিষাক্ত কলম আর লোকগীতি হয়ে।

নির্ঝর মুখোশ পড়ে নিল। আর পাঁচজন হওয়ার মুখোশ। যেই পাঁচজন মায়ের মন রাখতে যায় একের পর এক বাড়িতে, সব মৃন্ময়ীর মাঝে আঁধার কালো চাহনি খোঁজার অজুহাতে চায়ের কাপে লুকোয়ে কান্না, আর “ না আমার পছন্দ নয়” বলে মিথ্যেই ফাঁপা পৌরুষের ভান দেখায়।

 

দূরদর্শনের খবরে বলছে, এবছর ৪ঠা জুলাই  অফিসিয়াল ডেট ছিল, বর্ষা আসার, কিন্তু এখনও আসেনি। নির্ঝর টিভি টা বন্ধ করে দিয়ে চিলেকোঠার জানলায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে গর্জন, মৃদু। মেঘের। আজ আর রোমাঞ্চ বা সংকোচ , কোনটাই নেই মেঘের, নির্ঝরের কাছে। দুজনেই আজ নিরুত্তাপ, প্রশান্ত। পাশের নতুন ফ্ল্যাট থেকে “শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে’’-র আলতো শ্লেষ ভেসে আসছে। মা ছাতের টবে গাছ লাগিয়েছে। বাহারি ফুলগাছ , শৌখিন পাতাবাহার। সেই না দেওয়া জন্মদিনের ক্যালেন্ডারটা ঘরটার এককোণে ধুলোমাখা অবহেলায় ম্রিয়মান। নির্ঝর মৃতপ্রসবিত শিশুর মত ওকে তুলে আনে, পাতাগুলো উলটে উলটে আজকের তারিখে থমকায়, আজ সেই প্রথম বৃষ্টির কলকাতা  আর ভেজা মাটির ঠোঁটের রেড লেটার ডে।

টবের ক্যাকটাস এ নতুন পাতা?! ছোট, ছোট, প্রায় ইনভিসিবল , তবু পাতাই তো! আগে কোনদিন স্বচক্ষে ক্যাকটাসের পাতা দেখেনি নির্ঝর। কি একটা অসমাপ্তির অসস্তি হচ্ছে ভেতরে হঠাৎ করে।

ফোনটা পকেট থেকে বের করে নাড়াচাড়ার ফাঁকেই কেমন নিষিদ্ধ আকর্ষণের মত বেরিয়ে পড়ে M এর কনটাক্ট লিস্ট।

হিমবাহ ভাঙতে ভাঙতে একটা কল যায় নাম্বারটায়।

শেষ অক্সিজেনটুকু সঞ্চিত রাখার প্রতিশ্রুতির কয়েকটা  মুহূর্তের অপেক্ষার ওপারে ফোনের একটানা রিং এ বাধা পড়ে। একটা বহুল পরিচিত , বহুল প্রতীক্ষিত হ্যালো।

“নির্ঝর, একবার দেখা করতে পারবি? ’’ এক নিঃশ্বাসে কালবৈশাখী ধেয়ে  আসে।

চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর, কোঁকড়া চুলে জড়িয়ে যাচ্ছে কলকাতার প্রথম বৃষ্টি। নির্ঝরের হুঁশ নেই, ওর আজ আকাশ বাতাস দিগন্ত জুড়ে শুধু ভেজা মাটির নেশা নেশা গন্ধ ।

 

 


Leave a comment

পুজোনামচা

পুজোনামচা – ১

ষষ্ঠী

লেবু চা, পুতুল নাচ আর স্ট্রিটলাইটের মা

বেরিয়েছিলুম আজ, ষষ্ঠী, থুড়ি মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায়। কি যেন বলি আমরা? প্যান্ডেল হপিং। দেশপ্রিয় পার্ক না হয় বন্ধ, তার জন্য সেই শুক্রবার সাড়ে ছটার কাটোয়া লোকালের ভিড় টা নেই; তবে কিছু কমতি নেই মানুষের উৎসাহে। ঝলমলে নয়নাভিরাম আলোকসজ্জা, রীতিমত গভীর self-analysis এ নিমগ্ন  করে দেওয়ার মতো থিম, নামকরা শিল্পীদের নজরকাড়া শিল্পনৈপুন্যে ঋদ্ধ এক একটা পুজো । কেউ কারোর চেয়ে কম যাওয়ার পক্ষপাতী নয়। প্রতিবছর একই চেনা জায়গাগুলোর আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে  ওঠাটা সবসময়ই কেমন একটা আশ্চর্য লাগে। যেহেতু কিছুদিন আগেই কয়েকজন বাচ্চার মুখে পুজো- নামাঙ্কিত হাসিটা ফোটানোর একটা ছোট প্রচেষ্টা নিয়েছিলুম, নিয়মমাফিক আমার উচিত ছিল পুজোতে আনন্দে যাকে বলে উদ্বেলিত না হয়ে ওঠা। যে ছেলেটার থেকে ধুপকাঠি কিনলুম সহানুভূতি দেখিয়ে, বা যেই ভিখারি বাচ্চাটাকে আমার চকোলেট টার অর্ধেক ভাগ দিলুম, বা যেই মেয়েটা আমার আইসক্রিমের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে ছিল…হয়তো উচিত ছিল আরও একটু মুখ বেজার করার, আরও দু-এক ফোঁটা আড়ালি চোখের জল ফেলার। হল না, জানেন তো! কিছুতেই পারলাম না নিজের উচ্ছলতাকে দমন করতে, বুঝলুম বড় হওয়া বাকি রয়ে গেছে। বরং কেমন একটা আনন্দ হল, রঙচঙে সবুজ জামাটা পরে যে ক্লাস ৫ বাবার সাথে প্রথম কলকাতার পুজো দেখার বিস্ময়কে লুকোনোর কাঁচা অভিনয় করে বড় হয়ে গেছি ভাব নিয়ে , “এদিকে আসুন, লেবু চা, লেবু চা” করে হাঁক পাড়ছিল, তাকে দেখে; তার সন্তর্পণে এগিয়ে দেওয়া প্লাস্টিকের  চায়ের কাপে ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে বেরনো রামধনু আলোয় উজ্জ্বল দুটো চোখ দেখে।

হিন্দুস্থান পার্ক সার্বজনীন এর প্যান্ডেল টা কটা পুরষ্কার পেয়েছে জানিনে, তবে স্বাদটা এখনও লেগে আছে মায়ের হাতের ভোগের পায়েসের মত। মেলা দেখেছি ছোট থেকে অনেক, তবে ওই টয়ট্রেন , ব্রেকডান্স, প্লাস্টিকের নিত্যনতুন খেলনার সম্ভারে আক্রান্ত আমার মেলা- স্মৃতি। মা-র কাছে শুনতুম , মায়ের ছোটবেলার মেলার পুতুল নাচে রামায়ণ, রথের মেলার তালপাতার পাখা, চার আনার নির্ভেজাল উচ্ছ্বাস, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, আশ্চর্য জাদুকরের ভেলকি, লক্ষ্মীসরার গল্প। সব দেখলুম ওখানে! নিজের ইমাজিনেশনের এরকম জলজ্যান্ত প্রজেকশন জীবনে খুব কম উপভোগ করে বিস্মিত হয়েছি।

পুজোর সাজে মেকওভার পাওয়া কল্লোলিনীর চেনা গলিকেও অচেনা ভেবে হারিয়ে যাওয়ার বাতিকটা এখনও বহাল আমার। সেখানেই পুজো- পুজো লাইট- সাউন্ড আবহের বাইরের এক স্ট্রিটলাইট চোখে পড়ল। হলুদ আলোর নীচে ছেঁড়া শাড়ির মাতৃরূপেন সংস্থিতা। আর এক নতুন লাল জামার ছোট মেয়ে।  হয়তো বড় পুজোর জৌলুস গায়ে মাখার অলিখিত পাসপোর্টের লিস্টে ওরা ব্রাত্য। “মা এবার খাব?”

“না এখন খুলিস না এটা।“

“মা খাই না, দাও না খেতে…”

“আচ্ছা আচ্ছা যা…” কথা শেষ হওয়ার আগেই ছিঁড়ে ফেলা একটা দশ টাকার চিপসের প্যাকেট। আর উন্মুক্ত অনেকটা আনন্দ…আনকোরা, নিখাদ, উচ্ছল।

পুজো এসে গেছে যে।।


Leave a comment

কাঠবেড়ালি

অদ্য শ্রীমান শতদ্রু মহাশয়ের চাউমিন প্রস্তুতিতে হাতেখড়ি ঘটিল।

 

এবং সেই অদ্ভুত কিছু সবজি সহযোগে বেশ উপাদেয় খাদ্যবস্তুটির পৃথিবীর আলো দেখা সার্থক করলাম আমি এবং এক অপ্রত্যাশিত অতিথিদ্বয় । এক কাঠবেড়ালি দম্পতি।

 

গাছের গুঁড়ি তে ঠেস দিয়ে বসে সারাদিনের অভুক্ত প্রত্যাশা-র সঙ্গে পরম উৎসাহে পাচকের জিজ্ঞাসু উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি আড়চোখে উপেক্ষা করে এক দুই তিন করে চামচ মুখে পুরছি ; আর পাচক মহাশয়ের আমার থেকে প্রশংসা পাওয়ার আশা ক্ষীণতর হওয়াতে যখন তিনি নির্লিপ্ত ভান করে এদিক ওদিক দীর্ঘশ্বাস ছড়াতে ব্যস্ত, হঠাৎ তার দৃষ্টিগোচর হল এক নিরীহ কাঠবেড়ালি অত্যন্ত প্রত্যাশী ভঙ্গি তে আমার চাউমিন খাওয়া দেখছে। তার নির্দেশে এক চামচ অতি সন্তর্পণে মাটিতে নিক্ষেপ করা হল। কাঠবেড়ালি মশাই ইতিউতি চেয়ে এক লাফে নেমে এলেন গাছ থেকে। আর একটু গা চুলকে ল্যাজ নাড়িয়ে গোঁফে চাড়া দিয়ে শুরু হল তার ভোজনপর্ব। আমরা দুজন খাওয়া থামিয়ে দেখলুম বেশ সেটা । খুঁটে খুঁটে অতি দ্রুত চাউমিন এর টুকরো গুলো খেয়ে তিনি দু হাত দিয়ে ধরে ডিমের টুকরো টা বেশ একটু কায়দা করে খেলেন। আমি উদ্বেলিত হয়ে তাকে আরও খানিকটা খেতে দেওয়াতে দেখলুম তিনি আর পালাচ্ছেন না, বেশ বীরদর্পে রাজকীয় ভঙ্গিমায় খাচ্ছেন পরম সুখে। শতদ্রু বাবু কে দেখলুম বেশ খুশিখুশি , আমি না হলেও কাঠবেড়ালিটি তার পরিশ্রমের মর্যাদা দিল বলে কথা । তার অতি উৎসাহে কাঠবেড়ালি কে গাজরের টুকরো দেওয়া হলে সে সসম্মানে তা প্রত্যাখান করল। এবং হঠাৎ ই প্রস্থান করল। আমরা খানিক আশাহত হলেও বেশ লেবু চা নিয়ে গুছিয়ে বসেছি;

ওম্মা!!! কী কাণ্ড!! কাঠবেড়ালি তার অন্তঃসওা অর্ধাঙ্গিনী কে নিয়ে হাজির। কাঠবেড়ালির ইচ্ছে ছিল বোধহয় একসাথে বেশ জমিয়ে লাঞ্চ সারবেন; কিন্তু সম্ভবত দাম্পত্য কলহের দরুন ( শতদ্রু-র থিওরি) কাঠবেড়ালিনী তাকে এক ধমকে তাড়িয়ে দিলেন, এবং তারপর একইভাবে তার ভুরিভোজ সারতে লাগলেন। শতদ্রুর সমগ্র পুরুষ প্রজাতি দের সংসারে এক ই দশা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মাঝেই তার খাওয়া কমপ্লিট করে এক ফেলে দেওয়া চা এর ভাঁড় থেকে কয়েক ফোঁটা চা খেয়ে আবার দূরে করুণ চোখে অপেক্ষা করা বর মহাশয় কে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন গাছের ডালে।

 

পুনশ্চঃ ভাবছি আজকের এই অভিজ্ঞতা টা শিক্ষামূলক ক্যাটাগরি তে রাখব কিনা