আমরা যারা ফেসবুক আর নিজেদের বিনি পয়সার ব্লগের বাইরে হালে পানি না পাওয়া “লেখক” , তাদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। ১৪ই হোক বা ২১ , ফেব্রুয়ারিতে কিছু না কিছু আগডুম বাগডুম বিদ্রোহী কচকচানি পোষ্টাতে হবেই। প্রেম দিবসের অযৌক্তিকতা হোক বা ভাষা দিবসে “বং”সমাজের ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখানো , ফেবু দেওয়াল লিখনে লাইকের সংখ্যাটা ৩০ ছাড়ালেই বেশ একটা “মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে…” গোছের আচিভমেন্ট মনে হয়। তাপ্পর যখন পরিচিত কারোর লেখায় ২০০-২৫০ লাইক দেখা যায়, তখন কাল্পনিক পেন্নাম ঠুকে “গুরুদেব” কমেন্ট করাটা অনিবার্য।
সকালের কাঁচা ঘুমটা যখন পাড়ার ক্লাবের “মোদের গরব মোদের আশা’’ দ্বারা ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হল, মনে মনে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় বাছা বাছা কিছু শব্দ প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে ভাষা দিবসের শুভ সূচনা ঘটল।
একবার এক বন্ধুবর বলেছিলেন, বাঙালি আদর করে বাংলায়, কিন্তু ঝাড়ে ইংরেজিতে। কথাখানা খাঁটি। তবে মাইরি বলছি, আমার বিশ্বাস সেটা স্থান-কাল-পাত্র সাপেক্ষ। ধরুন নব্য প্রেমিকার সামনে ফোন এলো কোন “বাতাসল্যাজ” কোম্পানির নেকাপিনার। তখন ইংরেজি আবশ্যক। কিন্তু সেই প্রেমিকাকেই বিয়ে করলেন, সুখে থাকলেন ; তখন কিন্তু জিরেগুড়োটা নেই কেন সেই বচসায় শালিমার নারকোল তেলের মত বাংলাই বেরোবে। বা ধরুন ফ্লিপকার্ট আপনাকে জালি ডেলিভারি দিয়েছে। তখন তো শেক্সপীয়ারকে কবর থেকে জাগিয়ে তোলার যজ্ঞের আয়োজন করা অবশ্যম্ভাবী। অথচ “ডাক্তারবাবু কদিন ধরে লুজ মোশান কমছে না ’’-র পরবর্তী আলোচনাটা কিন্ত আপনার সুরুচিসীমা পেরিয়ে অ্যাঁ মরি বাংলা ভাষাতেই হবে। সে আপনি যতই লাল-নীল-হলুদ-(সবুজ) হয়ে যান না কেন লজ্জায়। বেরিয়ে ঝটিতি ইন্টারনেট ঘেঁটে আপনার বাংলা রোগের জার্মান/ জাপানি/ লাতিন পরিভাষা মগজস্থ করে নেবেন, পরদিন সহকর্মীদের শোনাতে তো হবে?
আজকে অনেক “আমার মেয়ে বাংলাটা ঠিক পারে না” বাবলির মা, “ইশ…রবীন্দ্রসঙ্গীত! ” ন্যাকাপিনা, “হ্যাপি ভাষা দিবস টু অল অফ ইউ” ডারপেন্দ্র দের ওপর অনেক ধিক্কার করেছেন সারাদিন ধরে।
আমারও লাগে, খারাপ লাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু এটা ভয় পাবেন না, বাংলা ভাষা মরবে না কোনদিন। আচ্ছা আমাদের মায়েরাও তো তাদের শখ অনুযায়ী সাজগোজ করেন, তা বলে কি ঘুমোতে যাওয়ার আগের আঁচলের মা-মা গন্ধটার তারতম্য হয় কোনদিন?
বিয়েবাড়িতে হয়তো আপনার শিফন শাড়ি আর হল্টারনেক ব্লাউজ অনেক “র্যাভিশিং” “সেক্সি” “হট”-এর ছয়লাপ করে দিল। তা বলে কি অষ্টমীর ঢাকাই জামদানিতে মায়ের “তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, কত বড় হয়ে গেলি”-র মাহাত্ম্য কম হয়?
পিজার ওপরের এক্সট্রা চিজ আয়েশ করে “ইয়াম্মিইই…” বলে খাওয়াটা নিঃসন্দেহে স্বর্গীয় , তা বলে কি শীতের প্রথম নলেন গুড়ের রসগোল্লা মুখে পুরে অস্পষ্ট “আহা” –র সাথে তার কোন তুলনা হয়?
ব্রেকআপের পরপর পিঙ্ক ফ্লয়েড । হিলিং। জানি। কিন্তু অনেকদিনের পরের আলগা বর্ষার রাতে হঠাৎ ছেয়ে আসা মনকেমনের “ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে…” ; আপনিই বলুন?
“I love you যত সহজে বলা যায়-
“আমি তোমাকে ভালোবাসি” ততো সহজে বলা যায় না।” আমার নয়, হুমায়ুন আহমেদের কথা।
হিচকক। নোলান। স্করসেসি। ঘোর কাটতে সময় লাগে এক এক ক্ষেত্রে। কিন্তু হরিহরের ফিরে আসার পর সর্বজয়ার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েননি, এমন বাঙালি খুঁজে বের করুন তো?
তাই হে বঙ্গবাসী। শঙ্কিত হইবেন না অযথা। আমাদের মা ছিলেন। আছেন। থাকবেন। বেশভূষা বদলান একটু মাঝে মাঝে নাহয়।
ভেবে দেখুন না, আমি খাই ইলিশ পাতুরি, দেশের বাড়িতে গেলে বলি “আইলাম, যাইলাম , অহন, ক্যাডা, পোলা ।’’ লাল-হলুদ ।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু খান পোস্ত । বলেন “ নোব, দোব, এতগুনো , হাঁসপাতাল।’’ সবুজ-মেরুন।
এদের মধ্যে কে বাঙালি নয় ? বলুন দেখি!
আমি লিখি “আছি, করছি, পড়ছি।’’ ময়নার মা বলে “ বুদি, টমাটমের চাটনি কইরেছ আজ? ’’ পশুপতিকাকুর রিক্সায় চাপলে একগাল হেসে বলে, “কুথায় যাবে গো মা? কাল আসো লাই কিনো ? ছুটি ছিল বটে? ’’ পড়াতে গেলে স্টুডেন্টের বাড়ির রান্নামাসি গল্প জোড়েন , “ আমাদের উখানে মেইদের ১৮-১৯এ বিয়া হই যায়। ইসব চাকরি টাকরি করে না কেউ।’’
বাঙালি বলে অস্বীকার করব কাকে?
তবে সেইভাবে ভেবে দেখলে বাংরেজি কেও অমান্য করতে পারি না আমি।
জনৈক বাংলাদেশীয় বন্ধু বলেছিল ওপার বাংলার, ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘরের সমারোহ, আজকের দিনটায়। কবে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে জানিনা।
ততদিন বেঁচে থাক আমার রাঢ়ী , বঙ্গালী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খণ্ডি , কামরূপী। বেঁচে থাক আমার বাংরেজি। বেঁচে থাক আমার বাংলার মাটি, বাংলার জল। বেঁচে থাক বিশ্ববাংলা। বেঁচে থাক আমার ব এ ওকার , চ এ ওকার। বেঁচে থাক একুশে ফেব্রুয়ারির ছুতোয় আইবি-র বদলে খাঁটি “বাংলা”র আসর। বেঁচে থাক বাঙালি, বেঁচে থাক বাংলা।
পুনশ্চ ঃ অধমের সীমিত জ্ঞান নিয়ে বাংলা ব্যাকরণ ,ইতিহাস, পরিভাষা নিয়ে বাগবিতণ্ডা করবার ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন গুনীজনেরা।