মাধ্যমিকটা ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা, এবং দুর্ঘটনাও বটে। বরাবর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা গোবেচারা ছাত্রী ছিলাম। “মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে” আর কি! কো -এডে পড়তাম, পড়ার থেকে মুখ তোলার ফাঁকটুকুতে ওই বয়সোচিত কিছু গাল রাঙানো মুহূর্তও ছিল ক্লাস সেভেন- এইট থেকে। তবে মাথার ওপর ঝুলিতেছে খাঁড়া, মাধ্যমিক। না জানি সে কত ভয়ঙ্কর এক দত্যি দানো , তবে সে আসার আগে অন্যকিছু করলে বা ভাবলেই নাকি সব শেষ। গান শিখতে কোনকালেই বিশেষ আগ্রহী ছিলাম না, তাই ক্লাস এইটের শেষে হারমোনিয়াম বাক্সবন্দী হয়ে যাওয়াতে বেশ মজা পেয়েছিলাম, তবে আঁকার তুলিগুলো রং শুকনোর আগেই কেড়ে নিয়েছিল মাধ্যমিক, আজও ক্ষমা করিনি …
তা এই কালান্তকারী মধ্যবিত্ত বাঙালী মেডুসাকে আপ্যায়ন করতে আয়োজন নেহাত কম করিনি, বাবার কাছে অঙ্ক, আর বাংলা বাদে বাকি সব টিউটর , দিনের শেষে বাড়ি ফিরে বিছানাটা মনে হত স্বর্গ , আর মায়ের মাথায় বোলানো হাতটা যেন মেডুসার অভিশাপের মাঝে স্বপ্নপরীর জাদুকাঠির ছোঁয়া।
ঢোঁক গিলে একশা হয়ে ,পকেটে ঠাকুরের ফুল আর একবুক অতিকষ্টে জড়ো করা বাহারি কনফিডেন্স নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম অচেনা একটা লাস্ট বেঞ্চের কোণে। উতরে গেল ভালোভাবেই সব, এখন চুপি চুপি বলি , অঙ্ক পরীক্ষায় কটা অবজেকটিভ উত্তর মিলিয়েছিলাম পাশের বান্ধবীর সাথে। যদিও কোন এক “দেবদূতে”র কৃপায় ১৫ দিন দু-স্বাগত বাড়তি ছুটি পেলাম, ফিজিকাল সায়েন্সের প্রশ্নপত্র লিক হয়ে যাওয়ায়।
পরীক্ষা শেষোলো। বহুদিন ডিউ থাকা ভেসে বেড়ানোর ছুটিটাও।
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ , ১৫ মিনিট বাদে রেজাল্ট, চোখ টিভিতে, মন আগের রাতের ভয়ানক দুঃস্বপ্নে। তা কদিন আগেই স্কুলের শংসাপত্র পেয়েছিলুম যার হাত থেকে, সেই সেদিনের প্রধান অতিথি পর্ষদ সভাপতি মহাশয়ের পাশের হার , মেধা তালিকার ফাঁকেই নেট জানাল ৮৯ % পেয়েছি। অঙ্কে ১০০। বাবার পরিশ্রম সার্থক, মা-র চোখ ছলোছলোর ফাঁকেই স্কুল থেকে প্রিন্সিপালের ফোন , স্কুলে থার্ড নাকি আমি, জরুরি তলব।
তারপর একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল, কোন একটা নিউজ চ্যানেল পাকড়াও করে নিয়ে গেল, কিসব জিজ্ঞেস করল, সারাজীবন স্টেজে উঠলে যার গলা কেঁপে ঘেমেনেয়ে একশা কাণ্ড হয় সে যে কি বলেছিলাম আজও মনে নেই। তবে ওরা বার্গার আর কোক খাইয়েছিল মনে আছে।
এখন যখন কলেজের এক একটা পরীক্ষায় পাশ মার্ক তুলতে হিমশিম খেতে হয়, মাধ্যমিকের দিনগুলো এখনও মেডুসার মতই পরিহাস করে। সেই জ্বালাটা আমিই বুঝি, বাবা মা-র আশাহত চোখ গুলো দেখলে এখন, আত্মীয়দের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি, “মেয়েটা পুরো বেকার হয়ে গেল” এই শোনার ভয়ে। ভুলেও মনে আনি না সেই দিন গুলো। ভুলেও না। ভাই বোনেদের পরীক্ষার আগের দিনগুলো তে তাই ফোন তুলে ভালো করে দিস বলি না; বলি, যা হয় হবে ভাবিস , এটা একটা পরীক্ষা শুধু যেটা ঘিরে অপ্রয়োজনীয় হাইপ, জীবনটা আরও অনেক বড়।