তেতোমুখে মা কে এককাপ চা দিতে বলে পেপারটা নিয়ে এসে বসে স্বপ্ন। আজকাল এটাও পড়া হয় কালেভদ্রে, দেরাজের সার সার বইয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও। তিন দিনের না কামানো গাল পেরিয়ে হাত থমকে দাঁড়ায় চোখের কোটরে। সেন্টার টেবিলে কাচের নিচে গোঁজা ছেলের রিপোর্ট কার্ড থেকে ইলেকট্রিক বিল। সেকি! সায়েন্সে মাত্র ১৬ ! সই করার সময়ে খেয়ালও করেনি। আগে বড় যত্ন নেওয়া হত ছেলেটার , আর এখন। কেমন যেন আটকে আসে স্বপ্ন-র গলার কাছটা। অদূরে রাখা নতুন পেটেন্ট পাওয়া পাওয়ার ইনভার্টার ঢেকে এসে দাঁড়ায় স্বপ্ন-র ছোটবেলা। চোখ ডলতে ডলতে জড়ানো গলায় বলে, “মা কোথায়?”
“আসবে বাবু। ফিরিয়ে আনব তোর মা কে।“ বলতে বলতে ভিজে যায় হলুদ রঙের কার্টুন আঁকা ছোট গেঞ্জিটা।
ছিঁড়ে ফেলা কার্ডটা ত্রস্তহাতে কুড়োতে থাকে শ্রমণা। প্রাণপণ আড়াল করা সত্ত্বেও অবাধ্য দু-চার ফোঁটা ন্যাকামি ভিজিয়ে দেয় দুবার সেলাই করানো চটিটার কোনা। অপটু হাতে আঁকা কার্ডের টুকরোর সঙ্গে বেনামি আধপোড়া সিগারেট আর ঘুণধরা একটা সম্পর্কের ঝুরোবালি ব্যাগবন্দি করে দ্রুত পা চালায়। ক্ষয়াটে মুখটার দিকে ঝাপসাভাবে আসছি বলে এগিয়ে চলে। আরেকটু স্পিড বাড়ালে ১২-৩৫ এর লোকালটা নিয়ে যাবে মুখটার থেকে নিরাপদ দূরত্বে।
“তোর কোন কমন সেন্স নেই? দেখিস তো সারাদিন কেমন পাগলের মত খাটে ছেলেটা? তাও এরকম করিস তুই ! তোর মা তো ওর জন্যই স্বাভাবিক…”
বাবার একটানা বলে চলাগুলো শ্রমণার কানে আবছা হয়ে আসতে থাকে। কিবোর্ড আর মাউস হা করে গিলতে থাকে মনিটরে ফুটে ওঠা একটা মেয়ের পরপর পাল্টে চলা ভিন্ন ভঙ্গিমার ছবির। মাউস ফিসফিস করে, আবার আরেকটা। কিবোর্ড উত্তর দেওয়ার আগেই অপর একটা নাম আবার ফুটে ওঠে স্ক্রিনে।
কিবোর্ড অনুভব করে শেষে ভেজা চোখে ফোলা ঠোঁট নিয়ে শ্রমণা অভ্যেস মত সেই বোতামগুলো টিপছে আবার। যাক শান্তি , আজকের মত। ডাউন কারসর কে সজাগ থাকতে বলে বাকিদের ঘুমোতে যাওয়ার অনুমতি দেয় ।
ঘুমের ঘোরে ভিজে জেগে ওঠে শ্রমণা। স্বপ্নে কেন আবার পুরনো কামের গন্ধ !
আজ যাবে না স্বপ্ন অফিসে। কোম্পানি নিজের হওয়ার এই একটা সুবিধা থাকলেও স্বপ্ন সেটার ব্যবহার করেছে এমন নজির বিরল। কমদিন তো পিশাচগুলোর খিদমতগারি করেনি, তবু জিগীষা কে কোনোদিন মরতে দেয়নি। এটাই স্বপ্ন তার সাফল্যের মন্ত্র বলে জানায় স্টুডেন্টদের।
বক্তৃতাগুলো দিতে দিতে স্বপ্ন মনে মনে প্রত্যয় অনুভব করে, জীবনে অনেক প্রলোভন , অনেক ডিসট্রাকশন উপেক্ষা করেছে বলেই না আজ এই জায়গাটা।
তবু কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা। পাত্তা দেয় না স্বপ্ন, হাসিমুখে উত্তর দেয় পরবর্তী প্রশ্নের।
পরদিন সারাটাদিন মুখ গোঁজ করে বসে থাকে শ্রমণা। প্রিলিমস ক্লিয়ার করেছে অক্লেশে , আর ৪ দিন বাদে মেইনস; উতরোলেই চাকরিটা হয়ে যাবে। সব অপমানের শোধ তুলতে পারবে হাতে টাকার জোরটা এলে। দাঁতে দাঁত ঘষে শ্রমণা। কিন্তু শিথিল হয়ে যায় অচিরেই। ওয়েদারটা এত ভালো।
এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন।
সব অভিমান গলে জল মেয়ের।
পরপর পাঁচবার কল করার পরেও উত্তর না পেয়ে দুশ্চিন্তিত হতে গিয়েও আটকে যায়, ঠিকই তো, জীবনটা হিন্দি ধারাবাহিক না, মুহুর্মুহু কহানি মে টুইস্ট আসবে। আবার আষাঢ়ে মেঘ ভর করে বৃষ্টি নামে চরাচর ছাপিয়ে।
ছেলের গা মুছিয়ে গামছাটা বারান্দার কোণে শুকোতে দিয়ে স্বপ্ন আড়চোখে দেখে নিল রোদের দিকে মুখ ফেরানো ইজিচেয়ারটাকে। রোজকার দৃশ্য, তবু কেমন একটা মায়া হল আজ বড় । আহারে বড্ড চড়া রোদ ওদিকটায়। আলতো করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই একটা বিকৃত দৃষ্টি প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে স্বপ্ন-র দিকে তাকাল। “চলে যাও, চলে যাও। আমি একা থাকব। একা থাকব আমি!” চিৎকারে ছিটকে স্বপ্ন কোনোমতে পালায় ছেলের বিস্ফারিত দৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে। মনে পড়ে যায় এক চড়া রোদের দুপুরের কথা। সেদিন স্বপ্নর বড় ইচ্ছে করছে এসব ফাইলপত্তর , সার্কিট ব্লুপ্রিন্ট ধুত্তোর বলে টান মেরে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে একটা ছাতার তলায় ঢুকতে। আর তারপর দুজনে মিলে মিয়নো ঝালমুড়ি আর আদর খাবে। বসের রাঙাচক্ষু উপেক্ষা করে ফোনটা হাতে নেয় সন্তপর্ণে। কল লিস্ট খোলার আগেই চোখ আটকায় ফেসবুক নোটিফিকেশানে। প্রাক্তনীর স্ট্যাটাস আপডেট। সরকারি চাকরির সিকিওরিটিকে ঘিরে রাখা অভিনন্দনের বন্যায়। একশটা মৌমাছি হুল ফোটানোর মত যন্ত্রণা হল যখন পরমুহুরতেই চোখ পড়ল টেবিলে রাখা মামুলি ফন্টের আইডি কার্ডটায়। এর ফাঁকেই ফের লালবাতির আর্তনাদ, আবার আরেকটা ব্রেকডাঊন। এই মুহূর্তটায় যখন ফোনটা ঝনঝন করে সুরলহরী তুলল, স্বপ্ন-র কানে সেটা সাইরেনের মত বিষাক্ত। তবু আলগা আবেগ এনে হ্যালো বলতেই যখন ওপার থেকে দুদিনের জমানো অভিযোগের বন্যা ভেসে এল, স্বপ্নর থুথু ছেটাতে ইচ্ছে হল নিজের গায়ে।
আর কোনোদিন কি ফিরে পাবে ওই এক ছাতার তলার দুপুর আর মিয়ানো ঝালমুড়ি?
চাকরিটা শ্রমণা পায়নি। এই নিয়ে কত নম্বর ব্যর্থতা হিসেব হারিয়ে ফেলেছে ও। ফের সেই এক রাউন্ড ব্লেডের অভিযান সারা শরীর সব নিভৃত অঞ্চল জুড়ে, আর লুকিয়ে রক্তভেজা রুমালটা ফেলে দেওয়ার ত্রস্ততা । কথা ছিল এইটাই লাস্ট চান্স, এরপর বিয়েটা করতেই হবে। পাত্র তো ঠিকই আছে, শ্রমণার নিজের পছন্দ , মা বাবার অত্যন্ত স্নেহের। আর কার কি বলার থাকতে পারে ? হইহই করে বিয়েপর্ব , হানিমুনপর্ব মিটে গেল। ডানা মেলা বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের মাঝে শ্রমণার মনে দানা বাঁধতে থাকে মায়ের একসময়ের অবস্থার আশঙ্কা। সেই নিদ্রাহীন রাত্রি, সেই কাউন্সেলর , সাইকিয়াট্রিসট , পারানইয়া, ওষুধের গন্ধে আচ্ছন্ন মা। শ্রমণার বরেরই কৃতিত্ব যদিও আজকে মা-র অনেকটাই সুস্থ জীবনে ফেরার পেছনে, তবু দুজনের রাতদিন ভীষণ ঝগড়ার মাঝের মেনটাল পেশেন্ট , ডাক্তার দেখানো উচিত তোমার প্রভৃতি বিশেষণ গুলো কি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন?
কে বলতে পারে সেই রক্তবীজটা কোনোদিন প্রকট হয়ে উঠবে না, শ্রমণা বা তার হবু সন্তানের মধ্যে? আড়ালে থাকা সাতমাসের পরিপূর্ণ শরীরটায় হাত বুলিয়ে চোখের জলকে বশ মানায় শ্রমণা।
এই বয়েসে স্বমেহনের ধকল আর লজ্জা কোনটাই মেনে নেওয়া যায় না। তবু কি আর করা যাবে, শারীরিক চাহিদা পরিত্যাগ করার মত ক্ষমতা থাকলেও একেকবার বিদ্রোহ করে ওঠে ইন্দ্রিয়গুলো। শেষ কবে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে মনে নেই স্বপ্নর।
পরের দিকে কেমন জড়ের মতো পড়ে থাকত মেয়েটা। হাজার চেষ্টা করেও স্বপ্ন জাগাতে পারত না, বিরক্ত হত ও, স্বপ্নকে ঠেলে সরিয়ে দিত। জোর করতে গেছিল একবার, সে কি বীভৎস চিৎকার। এই মেয়েটাই একদিন স্বপ্নর কাছে দিনে রাতে যখন তখন গা ঘেঁষে এসে বসত , গালে গাল ঘষত, আর গভীর চুম্বন।
ইশ, সেদিনও যদি স্বপ্ন জানতে পারত এই অনীহা- নিস্পৃহতার কারণটা। ইশ, বড্ড দেরি হয়ে গেল, বড্ড।
সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাজব্যান্ড । তখন বোধহয় নিজের কোম্পানি খুলবে বলে তোড়জোড়। সারাদিন ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা , কপালে ভাঁজ । নাওয়া খাওয়ার সময় নেই, ছেলেকে আদর করা তো দূরের কথা। ছেলেকে শ্রমণা একা হাতেই সামলেছে বরাবর। সংসারের বাকি কাজও । সারাদিনের পর শ্রমণা রাতের দিকে ঘন হতে চাইলে তা ফিকে পড়ে যেত ল্যাপটপের নীল বিমোহিনী আলোয়। একদিন জেদ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিতেই দক্ষযজ্ঞ। রাগের মাথায় শ্রমণা উগড়ে দিল এতদিন জমিয়ে রাখা সন্দেহগুলো।
কোন দ্বিতীয় বাক্যব্যয় ছাড়াই সেদিন শ্রমণার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গিয়েছিল স্বপ্ন। শুধু শ্রমণার শ্রবণ এড়ায়নি অস্ফুটে বলা “একদম মায়ের মত “ । সেদিনই যা ডিসিশন নেওয়ার নিয়ে নিয়েছিল শ্রমণা।
ছেলে যেদিন খেলনা খুঁজতে গিয়ে বিছানার তোষকের তলায় লুকিয়ে রাখা ফাইলগুলো টেনে বের করল, তদ্দিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। স্বপ্ন ততদিনে নিজের মা কে বাড়িতে এনে রেখেছে বাচ্চাটার দেখভালের জন্য মূলত । নিজে আর সময় পায় কোথায়?
প্রায় দুবছর আগে থেকে জমানো ফাইলগুলোতে যে ভারী ভারী ওষুধের নামগুলো লেখা ছিল প্রায় সবই খুঁজে পেল স্বপ্ন … ড্রয়ার, আলমারির এদিক ওদিক। রাখার কোনও ঠিক নেই, প্যাটার্ন নেই। চরম ধাক্কাটা খেলো ওপরের পেশেন্ট নেমটা
দেখে।
শ্রমণার মায়ের নাম।
স্বপ্ন-র মনে পড়ে যায় হানিমুনে গোয়ার ময়ূরনীল জলকে সাক্ষী রেখে শ্রমণার আশঙ্কার উত্তরে বলেছিল , “চুপ, আমি আছি না।“