ভুল রাস্তার মোড়ে


Leave a comment

হৃদ- মাঝারে

বাড়িটায় ও একা সেদিন।  বাড়িটা একটু জঙ্গল ঘেরা কেমন যেন , আশেপাশেও বাড়িটারি বিশেষ নেই। দূর থেকে মাইকে হিন্দি গান  তাল আর শালগাছের মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে একটা মিহি  আমেজের মত। সেদিন অষ্টমী। কিছুক্ষণ আগের একপশলা বৃষ্টিতে মাটির মিষ্টি গন্ধে ম ম করছে চারদিক। হৃদ একা জানলার ধারে বসে ছিল , হেডফোনে লো রিড এর “ ওয়াক অন দ্য ওয়াইল্ড সাইড” । বাড়িটায় ওর ঘরের রং গোলাপি আর আকাশির অদ্ভুত অন্তর্লীন একটা কম্বিনেশান; কী আশ্চর্য , বাবা তবে শেষে স্বীকৃতি দিল ওর পছন্দের?

হৃদ একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িময়, ওর বাড়িতে কাঁচের ছাদ , আকাশের টুপটাপ ঝরে পড়া গল্পগুলো ফুটে উঠছে ছাদের ক্যানভাসে।

টেবিলের ওপর পিকুমামার আমেরিকা থেকে এনে দেওয়া ব্যাটম্যান আর জি আই জো বসে খোশগল্প করছে, হৃদ পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে গেল। একটু দূরে বসে নিমিদিদির থেকে না বলে আনা চাইনিজ মেয়ে পুতুলটা অদৃশ্য একটা কাউকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে।

খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল হৃদ, অন্ধকারের দুধারে ঝাউগাছ, কুচি কুচি বরফ পড়ছে , ওপারে নার্নিয়া । আড়ালে সে দাঁড়িয়ে, মাথায় অলিভ পাতার মুকুট , একমুখ হাসি নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে।

একবার ফিরে তাকাল হৃদ। দেরাজ থেকে অস্কার ওয়াইল্ড মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। হৃদ আবেশে চোখ বুজে মিলিয়ে যেতে থাকল টুকরো টুকরো হয়ে, চোখ খুললেই দ্বীপের শেষ প্রান্তে মায়ের হাতে লাগানো পেয়ারাগাছের নীচে ওরা দুজন, একসাথে, কাঁধে মাথা রেখে ।

 

অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে চোখ খুলল হৃদ। হিয়া ওকে জাপটে ধরে চুমু খাচ্ছে।

 

হোটেলের হানিমুন স্যুইট থেকে ভিউটা অপার্থিব যাকে বলে।  সকালে উঠেই স্নান সেরে নিয়ে পর্দা সরালো হৃদ। সোনা-গলা পাহারচূড়ো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে রামধনু দ্যুতি, শৈশবীয় উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে খরস্রোতা ঝোরাটায়। হিয়া কী যেন নাম বলল নদীটার? পাহাড়িয়া গানের গন্ধ ছিল নামটায়, ইশ কিছুতেই মনে পড়ছে না। না মেয়েটা খুঁজে খুঁজে জায়গা চুজ করেছে বটে। হিয়ার বুক করা। বিয়ের ৩ মাস আগে থেকেই হানিমুনের টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং, ট্যুর প্ল্যান সব করে রেখেছে হিয়া।

হৃদের একবার মনে হল হিয়াকে ডেকে দেখায়। না থাক, কাল সারাদিন যা জার্নির ধকল গেছে, থাক ঘুমোক, আরও তো ৩ দিন আছে এখানে। উঠলেই অবশ্য ওই পাহাড়ি ঝোরাটার মতই প্রাণোচ্ছলতায়  ঝলমল বয়ে চলবে মেয়েটা। হৃদের খুব রাগ হল নিজের ওপর।

 

ওদের বিয়েটা আরেঞ্জড। বাবার কলিগের মেয়ে হিয়া, অনেকদিন ধরেই পরস্পরের পারিবারিক পরিচয়।

হৃদ বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট , প্রেম ট্রেম ও করেনি কোনোদিন।  এক্সিকিউটিভ প্রমোশনটা হওয়ার পরে পরেই বাবা একদিন রাত্রে খেতে বসে প্রস্তাবটা দিল, হৃদ বিনা বাক্যব্যয়ে ছাঁদনাতলায়। এবং এখন আপাতত হিমালয়ের কোলে ।

কফি দিয়ে গেল এইমাত্র, হিয়া স্নানে ঢুকেছে। হৃদ আয়েশ করে কম্বলটা  জড়িয়ে জানলার ধারে কাপটা নিয়ে বসেছে, শিল্পী ফোন করল এর মাঝে।

“কিরে দাদাভাই ! কংগো। পঁচিশেই হাতকড়াটা পরে ফেললি?”

“থ্যাঙ্কস। তোদের কি খবর বল, বিয়েতে এলি না তো? তোর শাশুড়িমা ঠিক আছেন এখন?”

“ হ্যাঁ ওই আর কি, বাড়িতেই এখন, কমপ্লিট বেড রেস্ট। ইশ কি যে মিস করলাম তোর বিয়েটা!”

“ কি আর করবি!”

“তারপর বল, খুব হানিমুন করছিস নিশ্চয়ই?” বোনের গলায় দুষ্টুমির আলতো আভাস “আমার বৌদি কোথায় এখন?”

“স্নানে গেছে।’’

“তারপর, তিনি তো সেই লেভেলের খুশি, কি বল? ’’

“হ্যাঁ সে একটু আছে বটে। ’’

“হু হু, হবে না? এতদিনের প্রেম? পুরো তো রম-কম মুভি মুভি গন্ধ ব্যাপারটায়।’’

শিল্পীর কথাটা বুঝে উঠতে সতর্ক হয়ে উঠল হৃদ।

“মানে?”

“ন্যাকামো করিস না তো দাদাভাই, অ্যাজ ইফ তুই কিছু জানিসনা…”

হৃদের প্রান্ত থেকে কোন সারাশব্দ না আসায় ঘাবড়ে গেল শিল্পী।

“ দাদাভাই তুই সত্যিই জানতিস না হিয়াদি লাইকড ইউ অল আলং ? ও তো বলে তুই রেসপন্ড করতিস না সেরকম, আমরা তো ভাবতাম ওটাই তোর সিগনেচার । ’’ মুচকি দুষ্টুমি ছুঁড়ে দেয় শিল্পী।

“শিল্পী, পরে কথা বলব রে, বেরোতে হবে।”

 

বাথরুমে শাওয়ার বন্ধ করতেই হিয়ার কানে আসে একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ, কেউ যেন বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদছে। তোয়ালেটা কোনোমতে জড়িয়ে ছিটকে বেরোয় হিয়া।

“হৃদ, অ্যাই হৃদ, কি হয়েছে তোমার? ’’ একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলকে উদ্বিগ্নতা মিশে যায়।

সাদা চাদরের সাথে লেপটে থাকা মানুষটাকে বেশ খানিকক্ষণ ধরে ঝাঁকায় হিয়া।

হৃদ মুখ তুলে হিয়ার দিকে তাকায়, ভীষণ অপ্রত্যাশিত একটা দৃষ্টি।

“কি হয়েছে তোমার? এই তো আমি, প্লিজ বলো।’’

“ অ্যাম সরি হিয়া, অ্যাম রিয়েলি সরি।’’ হৃদ কান্নায় ভেঙে পরে। এতদিনের চেনা এত ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটাকে এভাবে বেআব্রু দেখে হিয়ার দিশেহারা লাগে নিজেকে। হৃদের মাথাটা নিজের কোলের ওপর রেখে আস্তে আস্তে  হাত বুলিয়ে দেয়।  অসাবধান হয়ে আসে তোয়ালের ইচ্ছাকৃত ব্যারিকেড, সদ্যসিক্ত হিয়া হৃদের হাতটা তুলে দেয় বুকে।

হাতটা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সরে যায়, উঠে দাঁড়ায় হৃদ। বাথরুমের দরজা খোলা রেখেই মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে থাকে, দিতেই থাকে । যেন অস্পৃশ্য কিছুর ছোঁয়ায় ওর সমস্ত কিছু চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে দ্রুত। একবুক ভাঙা চাঁদের স্বপ্ন নিয়ে হিয়া এলিয়ে পরে বিছানায়।

 

 

মানালি থেকে ফিরে আসার প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। নতুন ফ্ল্যাটটা নেওয়া থাকলেও আপাতত হৃদের বাড়িতেই আছে ওরা। নতুন জার্নি শুরুর ঝাঁঝটা অনেকটাই মিইয়ে গেছে । দুজনের মধ্যে কথা বিশেষ একটা হয় না। তবে অমিল নেই।

মানালির ওই ঘটনাটার পর আর যে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটেছে তাও নয়। হৃদকে বারবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও ও এড়িয়ে গেছে , শেষে হাল ছেড়ে দেয় হিয়া। বাকি দিনগুলো ভালোই কেটেছে। সেই চাঁদের আলোয় নদীর ধারে ওরা সেদিন বসেছিল, আর পাইন – ঝাউগাছেরা চুপজগতের রূপকথা শোনাচ্ছিল, হঠাৎ হৃদ নিজের থেকেই শেলি ধরল। হিয়া বিমোহিত হয়েছিল আরও একবার, যেন হিপনোটাইজ। হৃদ নিজের থেকেই ওর কপালে আলতো করে চুমু খায় সেদিন। হিয়া সামলাতে পারেনি, বুনো লতা আর পাহাড়িয়া রাতের তারাকে সাক্ষী রেখে ওদের মিলন হয়েছিল।

 

সেদিন হিয়া অফিস থেকে ফিরল একটু দেরি করে, হৃদ চুপচাপ ঘরে টিভি দেখছিল। বরকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য পেছন থেকে একহাতে চোখ টিপে ধরে আরেক হাতে নাকের সামনে কোলোণের বোতলটা মেলে ধরল।

“হিয়া? সে কি! তুমি কি করে জানলে?” হৃদের এরকম অমলিন হাসি অনেকদিন বাদে দেখল হিয়া। বুক থেকে যেন একটা চাপা ভার নেমে গেল।

“গেস হোওয়াট। আজকে কার সাথে দেখা হল জানো?’’

বাচ্চাদের মত ঔৎসুক্য আর উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকানো হৃদের মুখটা দেখে একপশলা হেসে নিল হিয়া।

“মাজহার কে মনে আছে? আমার কলেজের বন্ধু, আরে তোমার সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম না? সেনকাকুর ছেলের জন্মদিনে?”

পলকে যেন অকালবর্ষা নেমে এলো হৃদ জুড়ে। থমথমে মেঘের মাঝে একচিলতে রোদ্দুরে হাসি ফুটিয়ে হৃদ বলল, “ ও তাই? কোথায় দেখা হল? কেমন আছে ও ?”

“ভালোই তো, উইপ্রো ছেড়ে ইনফোসিস এখন। বলল তো নতুন চাকরির চাপ তাই বিয়েতে আসতে পারেনি। কংগ্রাটস , অল দ্য বেস্ট অনেককিছু বলল- টলল। আমি তো তোমার জন্য পারফিউম খুঁজছিলাম, তখনই দেখা হল। ওই এটা নিতে বলল, বেস্টসেলার নাকি। এই এই জানো, ’’ হিয়া হাসি চেপে গলা নামিয়ে বলে , “ এখনও ওরকমই লেডিস লেডিস হাবভাব, গার্লফ্রেন্ডও তো জুটল না এতদিনেও।’’ হিয়া বলে চলে, “ এই জানো তো, প্রত্যুষ বলছিল মাজহারের সাথে নাকি ওর বাড়ির লোক যোগাযোগ রাখে না , মোস্ট প্রবাবলি হি ইজ গে, দ্যাটস হোওয়াই।’’

নিরুত্তাপ গলায় “ ও ’’ বলে উঠে যায় হৃদ। হিয়া পিছু ডাকে,

“ আরে কোথায় যাচ্ছ , শোনো না? একদিন ওকে আসতে বললাম , নতুন ফ্ল্যাটে। এই কবে যাব বলো না প্লিজ।’’ হিয়া আদুরে গলায় আবদার জানায়।

উত্তর না দিয়ে ধীরপায়ে বাথরুমে ঢুকে যায় হৃদ।

 

পারতপক্ষে হৃদের ফোন, ল্যাপটপে হাত দেয় না হিয়া। ওটুকু স্পেস না দিলে সম্পর্ক টেকে না বলে ও মনে করে। তবু কদিন ধরে হৃদের অদ্ভুত এই ডিপ্রেশন , অনীহা, কেমন একটা উইথড্রন যেন সবকিছু থেকে, ঘরে বসেও সারাক্ষণ কোথায় যে পড়ে আছে ঠিক নেই। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল হিয়ার ওর ফোন চেক করে। নিশ্চয়ই কোন অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছে, নাহলে আর কদিন বাদে বাবা হতে চলেছে, খবরটা জেনেও কি করে কেউ এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারে? হৃদের মত ছেলে, ওর পেট থেকে কথা বার করা সহজ নয়, এতদিনে এটা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে হিয়া, রাগও হয় মাঝে মাঝে খুব।

এখন হিয়ার সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হল হৃদের সাপোর্ট। দুটো প্রাণী মাত্র এই এত্ত বড় ফ্ল্যাটে, হিয়ার ফার্স্ট টাইম প্রেগনান্সি, কি করে সামলাবে? হৃদ কি বোঝে না কিছু? না কি? ভাবতে বসলেই হিয়ার বাঁধ ভেঙে জল আসে। নিজেই তো পছন্দ করেছিল লোকটাকে। খুব অভিমান হয় নিজের ওপর, মা বাবা কেন আটকাল না আমাকে? আইভরি রঙা দেওয়ালের কাছে হিয়া সব বলে, কেঁদে হালকা হয়।

সেদিন রোববার । দুপুরে আইপ্যাডে  খুটখুট করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল হৃদ। হিয়া পাশে বসে বই পড়ছিল। হিয়ার মাথায় রোখ চেপে গেল হঠাৎ, মনকে ঠিক বেঠিকের হিসাবের সুযোগ না দিয়েই সন্তর্পনে ঘুমন্ত হৃদকে পেরিয়ে আইপ্যাডটা নিজের কাছে নিয়ে এলো।  ফেসবুক খোলা।

আলতো করে চ্যাট লিস্টে হাত ছোঁয়াল। সবার ওপরেই মাজহারের নাম।

স্ট্রেঞ্জ? হৃদ মাজহারের সাথে যোগাযোগ রাখে? কোনোদিন বলেনি তো?

মাজহারের আনরিড টেক্সট। বিনা দ্বিধায় খোলে হিয়া।

“ বাবু? ঘুমিয়ে গেলে? লাভ ইউ। কাল আসবে কখন বলে দিও। ’’

হুহ??? দুয়ে দুয়ে চার করতে পারেনা হিয়া ঠিক, এটা মাজহারই তো? হ্যাঁ ওর ছবিই তো দেখাচ্ছে?

হিয়া বশীভুতের মত স্ক্রোল ব্যাক করতে থাকে।

দেড় ঘন্টা বাদে হৃদ ঘুম ভেঙে দেখে বিস্ফারিত জবাফুলের মত চোখ নিয়ে ওর দিকে স্থির তাকিয়ে আছে হিয়া, কোনওক্রমে অস্ফুটে বলে, “ কেন করলে হৃদ? কেন?’’

 

 

 

“আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না, কোনওদিন না।’’

ডাঃ মিত্রের চেম্বারের ভেতরটা এসি হলেও সবসময়েই খুব সাফোকেটিং লাগে হিয়ার। দেওয়ালগুলো হাজার মানুষের হাজার দুঃখ নিয়ে মহীরুহের মত গাম্ভীর্য নিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে সবসময়।

ডাঃ মিত্র সব শুনে প্রতিবারের মতন প্যাডে খসখস করে কলম চালান। আজকাল আর জিজ্ঞেস করেন না সবকিছু, শুধু ওষুধগুলো লিখে দেন। হিয়াও ক্লান্ত, এক জিনিস বারবার বলে বলে তার বোঝ আরও বাড়ে বই কমে না। তবুও আজকে বেরনোর আগে ডাঃ মিত্র আলতো হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “ হৃদের সাথে কথা হয়?”

অল্প ঘাড় নেড়ে দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে যায় হিয়া।

 

গত দু’বছরের ফ্ল্যাশব্যাক চলবে এবার সমস্ত বাসজার্নি জুড়ে।

কি করে ক্ষমা করবে নিজেকে হিয়া? মাজহারের সাথে হৃদের আলাপ? সেও তো হিয়ার সূত্রে।

হৃদের সাথে বিয়ে, জোর করে বারবার মিলিত হওয়া, হাসিমুখে সংসার যেন কোথাও কোন ফাঁক নেই, সবই তো হিয়ার নিজেরই বাবল অফ ফ্যান্টাসি। ও কি বুঝতো না হৃদের খামতিগুলো? অনীহাগুলো? তবু কেন বরাবর প্রশ্রয় দিয়ে এসছে নিজের মুখোশ পরা স্তোকবাক্য গুলোকে?

 

হিয়ার প্রেগনান্সির খবরটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্রে জেনেছিল মাজহার। সেই যে রোববার দুপুর ছিল, সেই সপ্তাহেরই বুধবার পোস্ট দিয়েছিল হিয়া। সেটা কি ইচ্ছাকৃত ছিল না? পারবে হিয়া অস্বীকার করতে আজকে? দুদিনের মধ্যে হিয়া চলে এসেছিল নিজের মায়ের কাছে। হৃদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চায়নি আর, অভিমান, বিতৃষ্ণার বশে কিছু না ভেবেই।

দুদিন পরে হৃদ ফোন করেছিল, মাজহারের আত্মহত্যার নিউজটা দিতে শুধু। ওর গলার কান্নায়  স্পষ্ট মিশে ছিল শ্লেষ , অনুচ্চ একটা ঘৃণা, হিয়ার প্রতি। সেই শেষ কথা বলা হৃদের সাথে। এখনও লিগ্যাল ডিভোর্স হয়নি ওদের ।

 

সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের শেষের দিকে, সাড়ে পাঁচ মাসে মিসক্যারেজ হয় হিয়ার। এক রোববার বিকেলে। মা ছিল রান্নাঘরে, বাবা টিভিতে মগ্ন। ছাতের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেছিল। সাথে সাথে এ্যাম্বুলেন্স , ছোটাছুটির মাঝে চাপা পড়ে গিয়েছিল সিঁড়ির নীচে পড়ে থাকা হিয়ার কলেজ বয়েসের স্টিলেটো জোড়া।

 

বাসে পাশে বসা লোকটার অসহ্য চাহনি সরিয়ে একবুক ঘেন্না আর কান্নায় নিজেকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল হিয়ার। ভারী চোখের পাতায় ঝাপসা জানলা দিয়ে আকাশ ডাকল হিয়া।

বৃষ্টিস্নাত পূর্বকোণে একটা রামধনু ফুটে উঠছে ।


Leave a comment

তারাদেরও স্বপ্ন ভাঙে

তেতোমুখে মা কে এককাপ চা দিতে বলে পেপারটা নিয়ে এসে বসে স্বপ্ন। আজকাল এটাও পড়া হয় কালেভদ্রে, দেরাজের সার সার বইয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও। তিন দিনের না কামানো গাল পেরিয়ে হাত থমকে দাঁড়ায় চোখের কোটরে। সেন্টার টেবিলে কাচের নিচে গোঁজা ছেলের রিপোর্ট কার্ড থেকে ইলেকট্রিক বিল। সেকি! সায়েন্সে মাত্র ১৬ ! সই করার সময়ে খেয়ালও করেনি। আগে বড় যত্ন নেওয়া হত ছেলেটার , আর এখন। কেমন যেন আটকে আসে স্বপ্ন-র গলার কাছটা। অদূরে রাখা নতুন পেটেন্ট পাওয়া পাওয়ার ইনভার্টার ঢেকে এসে দাঁড়ায় স্বপ্ন-র ছোটবেলা। চোখ ডলতে ডলতে জড়ানো গলায় বলে, “মা কোথায়?”
“আসবে বাবু। ফিরিয়ে আনব তোর মা কে।“ বলতে বলতে ভিজে যায় হলুদ রঙের কার্টুন আঁকা ছোট গেঞ্জিটা।

ছিঁড়ে ফেলা কার্ডটা ত্রস্তহাতে কুড়োতে থাকে শ্রমণা। প্রাণপণ আড়াল করা সত্ত্বেও অবাধ্য দু-চার ফোঁটা ন্যাকামি ভিজিয়ে দেয় দুবার সেলাই করানো চটিটার কোনা। অপটু হাতে আঁকা কার্ডের টুকরোর সঙ্গে বেনামি আধপোড়া সিগারেট আর ঘুণধরা একটা সম্পর্কের ঝুরোবালি ব্যাগবন্দি করে দ্রুত পা চালায়। ক্ষয়াটে মুখটার দিকে ঝাপসাভাবে আসছি বলে এগিয়ে চলে। আরেকটু স্পিড বাড়ালে ১২-৩৫ এর লোকালটা নিয়ে যাবে মুখটার থেকে নিরাপদ দূরত্বে।

“তোর কোন কমন সেন্স নেই? দেখিস তো সারাদিন কেমন পাগলের মত খাটে ছেলেটা? তাও এরকম করিস তুই ! তোর মা তো ওর জন্যই স্বাভাবিক…”
বাবার একটানা বলে চলাগুলো শ্রমণার কানে আবছা হয়ে আসতে থাকে। কিবোর্ড আর মাউস হা করে গিলতে থাকে মনিটরে ফুটে ওঠা একটা মেয়ের পরপর পাল্টে চলা ভিন্ন ভঙ্গিমার ছবির। মাউস ফিসফিস করে, আবার আরেকটা। কিবোর্ড উত্তর দেওয়ার আগেই অপর একটা নাম আবার ফুটে ওঠে স্ক্রিনে।
কিবোর্ড অনুভব করে শেষে ভেজা চোখে ফোলা ঠোঁট নিয়ে শ্রমণা অভ্যেস মত সেই বোতামগুলো টিপছে আবার। যাক শান্তি , আজকের মত। ডাউন কারসর কে সজাগ থাকতে বলে বাকিদের ঘুমোতে যাওয়ার অনুমতি দেয় ।
ঘুমের ঘোরে ভিজে জেগে ওঠে শ্রমণা। স্বপ্নে কেন আবার পুরনো কামের গন্ধ !

আজ যাবে না স্বপ্ন অফিসে। কোম্পানি নিজের হওয়ার এই একটা সুবিধা থাকলেও স্বপ্ন সেটার ব্যবহার করেছে এমন নজির বিরল। কমদিন তো পিশাচগুলোর খিদমতগারি করেনি, তবু জিগীষা কে কোনোদিন মরতে দেয়নি। এটাই স্বপ্ন তার সাফল্যের মন্ত্র বলে জানায় স্টুডেন্টদের।
বক্তৃতাগুলো দিতে দিতে স্বপ্ন মনে মনে প্রত্যয় অনুভব করে, জীবনে অনেক প্রলোভন , অনেক ডিসট্রাকশন উপেক্ষা করেছে বলেই না আজ এই জায়গাটা।
তবু কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা। পাত্তা দেয় না স্বপ্ন, হাসিমুখে উত্তর দেয় পরবর্তী প্রশ্নের।

পরদিন সারাটাদিন মুখ গোঁজ করে বসে থাকে শ্রমণা। প্রিলিমস ক্লিয়ার করেছে অক্লেশে , আর ৪ দিন বাদে মেইনস; উতরোলেই চাকরিটা হয়ে যাবে। সব অপমানের শোধ তুলতে পারবে হাতে টাকার জোরটা এলে। দাঁতে দাঁত ঘষে শ্রমণা। কিন্তু শিথিল হয়ে যায় অচিরেই। ওয়েদারটা এত ভালো।
এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকে না তো মন।
সব অভিমান গলে জল মেয়ের।
পরপর পাঁচবার কল করার পরেও উত্তর না পেয়ে দুশ্চিন্তিত হতে গিয়েও আটকে যায়, ঠিকই তো, জীবনটা হিন্দি ধারাবাহিক না, মুহুর্মুহু কহানি মে টুইস্ট আসবে। আবার আষাঢ়ে মেঘ ভর করে বৃষ্টি নামে চরাচর ছাপিয়ে।

ছেলের গা মুছিয়ে গামছাটা বারান্দার কোণে শুকোতে দিয়ে স্বপ্ন আড়চোখে দেখে নিল রোদের দিকে মুখ ফেরানো ইজিচেয়ারটাকে। রোজকার দৃশ্য, তবু কেমন একটা মায়া হল আজ বড় । আহারে বড্ড চড়া রোদ ওদিকটায়। আলতো করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই একটা বিকৃত দৃষ্টি প্রবল বিতৃষ্ণার সঙ্গে স্বপ্ন-র দিকে তাকাল। “চলে যাও, চলে যাও। আমি একা থাকব। একা থাকব আমি!” চিৎকারে ছিটকে স্বপ্ন কোনোমতে পালায় ছেলের বিস্ফারিত দৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে। মনে পড়ে যায় এক চড়া রোদের দুপুরের কথা। সেদিন স্বপ্নর বড় ইচ্ছে করছে এসব ফাইলপত্তর , সার্কিট ব্লুপ্রিন্ট ধুত্তোর বলে টান মেরে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে একটা ছাতার তলায় ঢুকতে। আর তারপর দুজনে মিলে মিয়নো ঝালমুড়ি আর আদর খাবে। বসের রাঙাচক্ষু উপেক্ষা করে ফোনটা হাতে নেয় সন্তপর্ণে। কল লিস্ট খোলার আগেই চোখ আটকায় ফেসবুক নোটিফিকেশানে। প্রাক্তনীর স্ট্যাটাস আপডেট। সরকারি চাকরির সিকিওরিটিকে ঘিরে রাখা অভিনন্দনের বন্যায়। একশটা মৌমাছি হুল ফোটানোর মত যন্ত্রণা হল যখন পরমুহুরতেই চোখ পড়ল টেবিলে রাখা মামুলি ফন্টের আইডি কার্ডটায়। এর ফাঁকেই ফের লালবাতির আর্তনাদ, আবার আরেকটা ব্রেকডাঊন। এই মুহূর্তটায় যখন ফোনটা ঝনঝন করে সুরলহরী তুলল, স্বপ্ন-র কানে সেটা সাইরেনের মত বিষাক্ত। তবু আলগা আবেগ এনে হ্যালো বলতেই যখন ওপার থেকে দুদিনের জমানো অভিযোগের বন্যা ভেসে এল, স্বপ্নর থুথু ছেটাতে ইচ্ছে হল নিজের গায়ে।
আর কোনোদিন কি ফিরে পাবে ওই এক ছাতার তলার দুপুর আর মিয়ানো ঝালমুড়ি?

চাকরিটা শ্রমণা পায়নি। এই নিয়ে কত নম্বর ব্যর্থতা হিসেব হারিয়ে ফেলেছে ও। ফের সেই এক রাউন্ড ব্লেডের অভিযান সারা শরীর সব নিভৃত অঞ্চল জুড়ে, আর লুকিয়ে রক্তভেজা রুমালটা ফেলে দেওয়ার ত্রস্ততা । কথা ছিল এইটাই লাস্ট চান্স, এরপর বিয়েটা করতেই হবে। পাত্র তো ঠিকই আছে, শ্রমণার নিজের পছন্দ , মা বাবার অত্যন্ত স্নেহের। আর কার কি বলার থাকতে পারে ? হইহই করে বিয়েপর্ব , হানিমুনপর্ব মিটে গেল। ডানা মেলা বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের মাঝে শ্রমণার মনে দানা বাঁধতে থাকে মায়ের একসময়ের অবস্থার আশঙ্কা। সেই নিদ্রাহীন রাত্রি, সেই কাউন্সেলর , সাইকিয়াট্রিসট , পারানইয়া, ওষুধের গন্ধে আচ্ছন্ন মা। শ্রমণার বরেরই কৃতিত্ব যদিও আজকে মা-র অনেকটাই সুস্থ জীবনে ফেরার পেছনে, তবু দুজনের রাতদিন ভীষণ ঝগড়ার মাঝের মেনটাল পেশেন্ট , ডাক্তার দেখানো উচিত তোমার প্রভৃতি বিশেষণ গুলো কি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন?
কে বলতে পারে সেই রক্তবীজটা কোনোদিন প্রকট হয়ে উঠবে না, শ্রমণা বা তার হবু সন্তানের মধ্যে? আড়ালে থাকা সাতমাসের পরিপূর্ণ শরীরটায় হাত বুলিয়ে চোখের জলকে বশ মানায় শ্রমণা।

এই বয়েসে স্বমেহনের ধকল আর লজ্জা কোনটাই মেনে নেওয়া যায় না। তবু কি আর করা যাবে, শারীরিক চাহিদা পরিত্যাগ করার মত ক্ষমতা থাকলেও একেকবার বিদ্রোহ করে ওঠে ইন্দ্রিয়গুলো। শেষ কবে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে মনে নেই স্বপ্নর।
পরের দিকে কেমন জড়ের মতো পড়ে থাকত মেয়েটা। হাজার চেষ্টা করেও স্বপ্ন জাগাতে পারত না, বিরক্ত হত ও, স্বপ্নকে ঠেলে সরিয়ে দিত। জোর করতে গেছিল একবার, সে কি বীভৎস চিৎকার। এই মেয়েটাই একদিন স্বপ্নর কাছে দিনে রাতে যখন তখন গা ঘেঁষে এসে বসত , গালে গাল ঘষত, আর গভীর চুম্বন।
ইশ, সেদিনও যদি স্বপ্ন জানতে পারত এই অনীহা- নিস্পৃহতার কারণটা। ইশ, বড্ড দেরি হয়ে গেল, বড্ড।

সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাজব্যান্ড । তখন বোধহয় নিজের কোম্পানি খুলবে বলে তোড়জোড়। সারাদিন ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা , কপালে ভাঁজ । নাওয়া খাওয়ার সময় নেই, ছেলেকে আদর করা তো দূরের কথা। ছেলেকে শ্রমণা একা হাতেই সামলেছে বরাবর। সংসারের বাকি কাজও । সারাদিনের পর শ্রমণা রাতের দিকে ঘন হতে চাইলে তা ফিকে পড়ে যেত ল্যাপটপের নীল বিমোহিনী আলোয়। একদিন জেদ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিতেই দক্ষযজ্ঞ। রাগের মাথায় শ্রমণা উগড়ে দিল এতদিন জমিয়ে রাখা সন্দেহগুলো।
কোন দ্বিতীয় বাক্যব্যয় ছাড়াই সেদিন শ্রমণার মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গিয়েছিল স্বপ্ন। শুধু শ্রমণার শ্রবণ এড়ায়নি অস্ফুটে বলা “একদম মায়ের মত “ । সেদিনই যা ডিসিশন নেওয়ার নিয়ে নিয়েছিল শ্রমণা।

ছেলে যেদিন খেলনা খুঁজতে গিয়ে বিছানার তোষকের তলায় লুকিয়ে রাখা ফাইলগুলো টেনে বের করল, তদ্দিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। স্বপ্ন ততদিনে নিজের মা কে বাড়িতে এনে রেখেছে বাচ্চাটার দেখভালের জন্য মূলত । নিজে আর সময় পায় কোথায়?
প্রায় দুবছর আগে থেকে জমানো ফাইলগুলোতে যে ভারী ভারী ওষুধের নামগুলো লেখা ছিল প্রায় সবই খুঁজে পেল স্বপ্ন … ড্রয়ার, আলমারির এদিক ওদিক। রাখার কোনও ঠিক নেই, প্যাটার্ন নেই। চরম ধাক্কাটা খেলো ওপরের পেশেন্ট নেমটা
দেখে।
শ্রমণার মায়ের নাম।
স্বপ্ন-র মনে পড়ে যায় হানিমুনে গোয়ার ময়ূরনীল জলকে সাক্ষী রেখে শ্রমণার আশঙ্কার উত্তরে বলেছিল , “চুপ, আমি আছি না।“


Leave a comment

দু-মুঠো দিনের ঝড়

“ধুর ,  তোর কাজকর্ম নেই নাকি শালা আলবাল হ্যাজাচ্ছিস বসে বসে? দোতলার ফিজিক্সের স্টাফরুমে ৫ টা কফি দিয়ে আয়।  ’’ তপনদা বহুদিন আছে এই কলেজে। ক্যান্টিনটার সর্বেসর্বা মানে সবাই ওকে। ওর ওপরে কথা বলার সাহস নেই শীর্ষেন্দুর। সে নতুন জয়েন করেছে।

সব পিতৃস্থানীয় কলিগদের মধ্যে একমাত্র খানিকটা সমবয়সী বিরজু। ওড়িশার ছেলে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলে। ওর সাথে কথা বলে সুখ নেই। আর বাকিদের সাথে বাজারদর বা কলেজের নতুন ব্যাচের ডবকা মেয়েদের নিয়ে আলোচনায় ওর কোন ভূমিকা থাকতে পারে বলে ভাবেওনি শীর্ষেন্দু। তবু আজকে একটা বর্ণনা শুনে এগিয়ে গিয়ে একটু ঔৎসুক্য প্রকাশ করতে গেছিল , এই ঝাড় জুটল।

মনটা তেতো হয়ে গেল। ট্রে টা হাতে তুলে নিয়েও বেরোতে ইচ্ছে করছিল না, কারণ জানে এখন ওই বর্ণনাকে  কিভাবে কুৎসিত অশ্লীলতার চটকদার মোড়কে ভরে পরিবেশন করা হবে। সবাই দেঁতো হাসি হাসবে; বিরজুও। এইসময়ে ও বাংলা বুঝতে একটুও ঠোকর খাবে না। শরীরটা এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে ছটফট করতে লাগলো শীর্ষেন্দুর।

কারখানার মেশিনে ডানহাত কাটা, ছাঁটাই হওয়া একটা পঙ্গু বাবা, রংচটা চুড়িদারের ক্লাস টেনের একটা বোন, আর দর্জির দোকানের ফাইফরমাশে বিধ্বস্ত একটা মা। বাড়িভাড়া আর ঋণশোধের জিজ্ঞাসাচিহ্নময় নোনা ধরা দেওয়ালে তেলচিটে লক্ষ্মীপটের গায়ে অভিমানের ধুলো; ধুলোতে মায়ের মাঝরাতের কাশি যখন ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে রেসোনান্ট হয়ে যায়, ওষুধ আর জলটা এগিয়ে দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়তে এখন আর অসুবিধে হয়না শীর্ষেন্দুর।

লাউশাক , চারাপোনার সংসারে কবিতা লেখা যে চলে না বুঝতে সময় লাগেনি সদ্য উচমাধ্যমিকের গণ্ডি ডিঙ্গনো শীর্ষর।ছুঁচ-সুতো-কামিজের মাপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন মায়ের হাতে  বালতি – ঝাড়ু ধরিয়ে দেওয়া হল, তার কদিন পরে শীর্ষেন্দু এই ক্যান্টিনটায় ঢুকল । সকালে কলেজ যাচ্ছি বলে বেরনোর সময়ে মনের সামনে ইংলিশ অনার্সের অ্যাডমিশনের লিস্টটা  বিদ্রুপ করে। সকালে ক্যান্টিন, বিকেল থেকে রাত অবধি টিউশনি , বোনকে নিয়ে বাড়ি ফেরা।

নন্দিতাকে ভালো লাগত। একবার সাহস করে একটা কবিতামাখা চিঠিও পৌঁছেছিল গোলাপিরঙা তেতলা বাড়ির কোনের ঘরটায়। সেটার আর হদিশ বা প্রত্যুত্তর কোনটাই পাওয়া যায়নি।বাবার অ্যাকসিডেন্টটার খবরটা আসার পর “একদিন দেখিয়ে দেব বড় চাকরি করে” গুলো  অচিনপুরের মর্গে ফ্যাকাশে হয়ে শুয়ে থাকল, কড়িকাঠের দিকে নির্বাক অচলদৃষ্টে।

 

খালি ট্রে টা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামার সময়ে ঘটলো ব্যাপারটা। বাঁক ঘুরতেই সোজা মুখোমুখি। কাল একটা নীল টপ ছিল, সামনের প্রজাপতিটায় টম্যাটো সস লেগে গেছিল, কুঞ্চিত ভ্রু শীর্ষেন্দুর কাছে টিস্যু চেয়েছিল, আরেক হাতে ধরা ছিল “ফার ফ্রম দা ম্যাডিং ক্রাউড” । আজ একটা বেগুনি কুর্তি, তবে চুলটা খোলা, দুদ্দারিয়ে উপরে উঠছিল, তখনই এই কাণ্ড।

ভেবলে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রাগ হতে গিয়েও হেসে ফেলল মেয়েটা। তড়াক করে সরে যেতে গিয়ে শীর্ষেন্দুর  “এক্সকিউজ মি”-র প্রতীক্ষা করা কানে একটা অচেনা শব্দযুগল প্রবিষ্ট হল।

“লাগেনি তো?’’

 

রবি ঠাকুরের গল্পে পড়েছিল “কর্ণ দিয়া মরমে পশিল গো” ব্যাপারটা।

 

আজ রাতে ঘুম নেই শীর্ষেন্দুর চোখে ।

মা অনেকক্ষণ ধরে কাশছে, তবে সেটা কারণ নয়। সারাদিনের ক্লান্তি , তবু কিছুতেই ঘুম আসছে না। পুরনো ক্যাম্বিস খাট টায় এদিক ওদিক করতে গেলেই মৃত্যুযাত্রীর শেষ আর্তনাদের মতো শোনায়। বিরক্ত হয়ে উঠে বেড়ালপায়ে হেঁটে দরজাটা খুলে বাইরে বেরোয় শীর্ষেন্দু ।

মায়ের একসময়ের শখের একটেরে বাগানের কঙ্কালটুকু পড়ে আছে। ভাঙা টবের দেহাবশেষের মাঝে একটুকরো স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ালো ও। বা হাতের চেটো দিয়ে চোখটা আলতো করে রগড়ে নিতে নিতে শীর্ষেন্দু দেখল ওর না ফোটা রেশমগুটি গুলো ধীরে ধীরে নীল বরফে ঢেকে যাচ্ছে,  নীল আকাশে ওড়া বেগুনি প্রজাপতি হওয়ার আগেই।

 

বোনের গায়ে ছেঁড়া রঙের স্নেহমাখা অনাভিজাত্য হালকা করে টেনে দিয়ে বিনা দীর্ঘশ্বাসে ঘুমিয়ে পড়ল শীর্ষেন্দু।

 

তিন মাস হল এই ক্যান্টিনে। মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল অক্টোবরের এক একেঘেয়ে সকালে। ছুটি পড়ার আগের দিন। অর্ধেক কলেজের ইন্টারনালের শেষ দিন। চা আর কফির ডিমান্ড সবচেয়ে বেশি হয় এসব দিনে। সকলেরই চেহারায় খুশি মেশানো স্ট্রেস। এর মধ্যে শীর্ষেন্দু দেখতে পেল একটা প্রজাপতি উড়ে উড়ে এলো, ছটফটে চুলে বেমানান ঋতুর গন্ধ। এসে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস  বলল, শীর্ষেন্দু বিভ্রান্তের মত এগিয়ে দিল। মেয়েটা মিষ্টি হেসে “থ্যাংকস” জানিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশে গেল।

সেদিন থেকে শুরু। সারা পুজোর ছুটি শীর্ষেন্দু গোলাপি-নীল একটা ঘোরের মধ্যে  কাটাল। একটা টিউশনি গেল, ছেলেটা সেবারও ক্লাস ৮ এর ষাণ্মাসিকে বাংলায় ফেল করল বলে। নতুন পাওয়া চাকরি আর টিউশানির টাকা জমিয়ে মা-র একটা ছাপাশাড়ি , বোনের কিছু সহায়িকা বইয়ের পরেও যেটুকু বেঁচে ছিল, সেই দিয়ে একদিন  কফিহাউসে কফি খেল, পাইরেটেড দুটো ইংরেজি গল্পবই কিনল, আর কলেজ স্কোয়ারের বিক্ষিপ্ত প্যান্ডেলের আড়ালে বসে থাকা যুগলদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল।  তারপর দিন রাতে মোমবাতি জ্বেলে ফের খুলল একটা হালকা হলদে পাতার লাল ডায়েরি। লিপিবদ্ধ হল ছড়িয়ে থাকা কথারা। একযুগ পর। তারপরের দিনও। তারপরের দিনও।

 

 

ঠিক ২৭ দিন ১১ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড বাদে ফের ঝড়ের আগের সন্ধ্যাতারার দেখা পেল  শীর্ষেন্দু। কলেজ খোলার পর প্রথম দুদিন আসেনি। তারপর এল; একদল বন্ধুর সাথে খিলখিলিয়ে। উৎসুক হয়ে বসেছিল শীর্ষেন্দু, একটা কোল্ড ড্রিংকস এগিয়ে দেবে বলে, কিন্তু সেদিন আর আসল না সে নিজে। আরেকজন কে পাঠালো তার খাবারটা নিয়ে যেতে।

তারপর আবার কদিন দেখা নেই। যেদিন এলো ৩ মিনিটের জন্য, সেদিন শীর্ষেন্দু বোকার মত মজে ছিল কোহলির ইনসাইড আউটে। গলার আওয়াজ শুনে যখন চমকে ফিরল, ততক্ষণে সে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বাচ্চা ছেলের পাড়ার ক্রিকেটে ব্যাট না পাওয়ার ঠোঁটফোলানো অভিমান নিয়ে সারদিন গুম হয়ে থাকল ও।

ক্লাস ৫ এর পুচকে একটা মেয়ে, ও বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস , ভূগোল পড়ায়। রোজকার মত মেয়েটার দাদু দরজা খুলল, মুখ আজ থমথমে। মাথা ঘামালো না শীর্ষেন্দু বিশেষ। ভেতরে ঢুকে দেখল মেয়ের বাবা, মা সকলে টেবিল জুড়ে আষাঢ়ে মেঘ হয়ে বসে। মেয়ে ধারেকাছে নেই।

“বোসো।’’ মেয়ের মা কড়া গলায় নির্দেশ দিল।

খানিকক্ষণ সবাই চুপ, শীর্ষেন্দু আঁচ টা পেয়েও পাচ্ছে না যেন।

“ এই ছেলে তুমি আসলে কি করো খুলে বল তো?” দাদু আর সামলাতে পারলেন না।

“আহ বাবা, আপনি চুপ করুন।’’ মেয়ের মা ধমকে থামিয়ে দেয়।

“শোনো, তুমি কোন কলেজে পড়ো যেন বলেছিলে?

“ চারুচন্দ্র কলেজ, ইংলিশ অনার্স।’’  আমতা আমতা করে বলে শীর্ষেন্দু।

“ কই প্রমাণ দেখাও, আইডি কার্ড কোথায়? ’’

“এখন তো সঙ্গে নেই। ’’ বেশ ঘাড় উঁচু করেই বলে ও।

“ বেরিয়ে যাও এক্ষুনি। একটা কলেজের ক্যান্টিনে কাজ করা ছেলে আমার নাতনিকে পড়াবে?  তাও আবার মিথ্যে পরিচয় দিয়ে? দাদুর কথাগুলোর নীরব সায় দেয় গোটা ঘরটা। মাথা হেঁট করে ঝাপসা চোখে বেরিয়ে যায় শীর্ষেন্দু। টুকরো টুকরো কথা তখনও এসে বিঁধছে তীক্ষ্ণ বরফকুচির মত।

“ভাগ্যিস সেদিন নীল এসে ছবিটা দেখে বলল”

“হ্যাঁ, তোমার মেয়ে তো আবার এইরকম একটা ছেলেকে ফেভারিট টিচার বলে নোটবুকে তার ছবি লাগিয়েছে।“

“কিরকম ডেস্পারেট ভাবতে পারছ? এতদিন এভাবে মিথ্যে বলে চালিয়ে দিল?”……

যেমন মায়ের সাথে ৯০ এর দশকের বাংলা সিনেমায় দেখত ছোটবেলায় হা করে, যেমন বড়বেলায় সত্যজিৎ,  মৃণাল সেন চিনে হাসত এসব ভেবে, তেমনি একটা কিছু যে বাস্তবেও ঘটতে পারে, এবং তার নিজের সাথেই, ধারণা ছিল না শীর্ষেন্দুর। আজ হঠাৎ ওই অতিরঞ্জিত , ঝাঁঝালো আবেগ আবহপূর্ণ ছায়াছবির বেনামি পরিচালকের প্রতি এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা জেগে উঠল।

 

 

“এই দাদা, আবার রাতে ঘুমনো বন্ধ করেছিস না? ইশ চোখগুলো কি লাল হয়ে আছে। কি হয়েছে বল তো তোর? কলেজে কিছু হয়েছে? ওই তপনদা না কে লোকটা, আবার কিছু বলেছে রে? দাদা, ওই দাদা শুনছিস?”

“ উফ চুপ করবি একটু তুই? ভালো করে পড় শুধু, সামনে টেস্ট। বাকি কিছু নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না।’’

দাদার ঝাড় খেয়ে চুপ করে যায় বোন।

আলু-বেগুন-ঝিঙ্গের চচ্চড়ি দিয়ে রুটি টুকরোটা মুখে পুরে রান্নাঘরের কালিঝুল মাখা শিকভাঙ্গা জানলাটা দিয়ে বাইরে তাকাল শীর্ষেন্দু। আচ্ছা, মেয়েটা এখন কি করছে? হয়তো সাদার ওপর লাল ফুটফুট চাদরে উপুড় হয়ে শুয়ে হয়তো উপন্যাস পড়ছে। নীল কুর্তির বেখেয়ালে বেরিয়ে পড়েছে ব্রা এর একটা ফিতে। শুয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে হয়ত উঠে বসল একটু , তারপর পাশে হাত বাড়িয়ে গ্লাসের কোল্ড ড্রিংকে চুমুক দিতে দিতে ফের ডুবে গেল ভিড়ের গভীরে।

 

“কি রে, খা!” মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরল শীর্ষেন্দুর।

মা একসময়ে অনেক বই পড়ত, বাড়িতে রোজ খবরের কাগজ কিনে আনত বাবা, আর মা-র জন্য কত রংবেরঙের ম্যাগাজিন। মা-ই নাম রেখেছিল শীর্ষেন্দু। প্রিয় লেখকের নামে।

 

পরদিন কি যে হল হঠাৎ,  একবার একঝলক লাঞ্চ ব্রেকের ভিড়ের মাঝে দেখেছিল ওই ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া খোলা চুল, উঁচু করে একটা লম্বা কাঁটা দিয়ে সামলে রাখা। তারপর ভুল বকতে শুরু করল শীর্ষেন্দু, তাও আবার বিরজুর কাছে। বোনের কথা, নন্দিতার কথা সব । তখনই তপনদার  ঝাড়টা খেল ।

আর তারপরেই ঘটল সেই ছায়াপথে নীহারিকা ধাক্কা খাওয়ার সময় থেমে যাওয়া ঘটনাটা।

 

সেদিন রাতে শীর্ষেন্দু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সবকিছু ঝেড়ে ফেলার, ছুঁড়ে ছিঁড়ে ফেলার। তার জীবন অন্য ধাতুতে গড়া  হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই, তার মতামত নেওয়ার অপেক্ষা রাখেনি। তাই পরদিন একজন ঝা চকচকে সুপুরুষ ছেলের হাত ধরে যখন সে ক্যান্টিনে ঢুকল, বা যখন তারা এক গ্লাস থেকেই কোল্ড ড্রিংক খেল, শীর্ষেন্দু থরথর করে কাঁপতে গিয়েও কাঁপল না। এই বরফের ঝড় তাকে হারাতে পারবে না, ভরসা আছে।

 

আর আছে বলেই পরের দিন , তারপরের দিন আর তারপর আরও অনেক অনেক গুলো দিন চোখের সামনে ভোরবেলার এক উত্তাল ঝড়ের ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে হতে বদ্ধ একমুঠো নিঃশ্বাস হয়ে যেতে দেখেও সে চুপ থাকল, নিশ্চল , নির্জীব।

 

বোন ততদিনে মাধ্যমিক পাশ করেছে। সায়েন্স নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু টিচার নিতে হবে সব সাবজেক্টে। তাই আর্টস।

নতুন স্কুলে যাচ্ছে বোন। সকালে স্টেশনে যাওয়ার পথে বোনকে পৌঁছে দিয়ে যায় স্কুলে;  পার্টি অফিসের পাশের মদের ঠেকটার কতগুলো ছেলে বেশ কয়েকদিন উত্যক্ত করেছে ওকে। কারও সাহস নেই গলা বড় করে প্রতিবাদ করবে। পরের বাড়ির মেয়ের হয়ে বলতে গিয়ে কেউই চায় না নিজের অন্দরমহলে বিপদ ডেকে আনতে। শীর্ষেন্দু জানে ওরা পাঁচজন ঘিরে ধরলে ও কিচ্ছু করতে পারবে না। ওর বোনও জানে। তবু একটা ভাসা ভাসা আশা নিয়েই বেঁচে থাকা। সবটা সময়।

মিথ্যে মিথ্যে তাসের ঘর সাজিয়েই তো মানুষ বেঁচে থাকে, যতই সে ভাবুক সে বাস্তবের শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে আছে।

 

বাবা বহুদিন ধরেই শয্যাশায়ী। ইদানিং একেবারেই অচল। বেডপ্যান কেনার আগে অবধি মাকেই সব পরিষ্কার করতে হত। ওষুধের খরচ হুহু করে বাড়ছে।  এর মধ্যে বাড়িওয়ালা আবার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।  মায়ের চেহারার দিকে তাকানো যায় না। সেদিন রাতেই কাশতে কাশতে রক্ত পড়ল। শীর্ষেন্দুর চোখ ফেটে জল আসে, বোনকে দেখে শিখেছে মুখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ঠায়।

শীর্ষেন্দুও নতুন কাজ  নিয়েছে আরেকটা । টিউশন মাত্র দুটো টিকে আছে। তাই কলেজ থেকে শিয়ালদহ হয়ে ফেরার পথে সান্ধ্য খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন কেনে। তারপর ওই দু ঘণ্টা ফেরি। মাঝে মাঝে বেঁচে যাওয়া ম্যাগাজিনগুলো সযত্নে এনে মায়ের বিছানার কোণে রেখে দেয়। মা চোখ বন্ধ করে হাসে ওর দিকে তাকিয়ে।

 

 

বাবা হাসপাতালে ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। রোজ মা গিয়ে দেখে আসত, খাইয়ে আসত রান্না করে নিয়ে। শীর্ষেন্দু ৩ দিন গেছিল, আর বোন একদিনই। শেষের দিন ওরা তিনজনেই ছিল, শীর্ষ দেখল মায়ের হাতটা চেপে ধরে বাবার হাত টা ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ল, কিছু একটা বলতে গিয়ে মুখটা থমকে গেল, খানিকক্ষণ  বিভ্রান্তির পরে মায়ের বুকফাটানো কান্না।

 

শীর্ষেন্দু কিন্তু কাঁদল না, বরং কাঁদতে চাইল কিন্তু পারল না। কিছুতেই না। অথচ ও পাথর হয়ে যায়নি, সচল । ও নিজেও অবাক হয়ে গেল , বাবাকে কি অনেকদিন আগেই হারিয়েছিল ও? মনে পড়ে না শেষ কবে বাবার পাশে বসে কথা বলেছে, বাবা টার শীর্ণ হাত ওর মাথায় বুলিয়ে দিয়েছে।

 

দুদিনের ক্লান্তি আর অবিন্যস্ত চুল, একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকল শীর্ষেন্দু। তপনদা বসতে দিল একটা বেঞ্চ টেনে। বিরজু চা-জল এনে দিল। শীর্ষেন্দুর অসহ্য লাগছে এসব। ও কাজ করতে এসেছে, ও জানে একদিনের টাকা কাটা যাওয়ার দাম কিভাবে চোকাতে হয়।

“তপনদা আমাকে কাজ করতে দাও” সংক্ষেপে বলে ও।

“বস না একটু, বুঝি রে তোর কষ্টটা । আমার বুড়ো বাপটাও তো, আজ আছে কাল নেই অবস্থা।’’ তপনদা আলগা আবেগ এনে গলা ভারী করে।

বিরক্ত হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। রোজকার কমলা হলুদ সূর্যাস্ত । তার মাঝেই হাতড়ে বেড়ায় একটা মানে, পারপাস।

“চাবিটা রইল, বুঝলি তো? বেরনোর সময়ে বন্ধ করে জমা দিয়ে যাস। আজ আবার মঙ্গলবার কিনা, একটু পুজো –আচ্চা থাকে, জানিসই তো…হে হে।’’ চোখ টিপে একটা জঘন্য হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায় তপনদা, পেছন পেছন শিস দিতে দিতে বিরজু।

শীর্ষেন্দু একা বসে থাকে একটা টেবিলে। কলেজে বেশি কেউ নেই এখন, ক্যান্টিন তো ফাঁকাই।

চাবির গোছ টা নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছিল । একটা দূর, অনেক দূর  থেকে ভেসে আসা, মহাশূন্যের ডাকে ঘোর ভাঙল।

“ কফি হবে?”

টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আজ। পরনে সেই নীল প্রজাপতি, যেটাকে স্বপ্নে ডানা মেলে উড়তে দেখে শীর্ষেন্দু।

তড়িঘড়ি উঠে কফি মেশিন থেকে এক কাপ কফি বানায়। এগিয়ে দেয় অচেনা বিষণ্ণ এক মুখের দিকে ।

মেয়েটা কিন্তু বেরিয়ে যায় না। কফি নিয়ে বসে সেই টেবিলটায় যেটায় এতক্ষণ শীর্ষেন্দু বসেছিল। ওর চাবিটা ওখানে এখনো। দূর থেকে দেখতে থাকে একজোড়া মনমরা চোখ কমলা হলুদ সূর্যাস্ত দেখছে। ও ও হয়তো পারপাস হাতড়ে ফিরছে।

চাবিটা আনতে যায় সন্তর্পণে, নিজের আধখাওয়া চায়ের কাপ টাও ওখানে এখনও, পরিষ্কার করতে হবে। সামনে গিয়ে একঝলক তাকাতে যায় আড়চোখে, ধরা পড়ে যায় ।

“বোসো” অচিনপুরের ঈশান কোণে বহুদিন বাদে কালো মেঘের আভাস বয়ে নিয়ে আসে শব্দটা ।

শীর্ষেন্দু বসে।

তারপর আর সামলাতে পারে না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে অবুঝের মত। এতদিনের জমানো বৃষ্টিরা কালো মেঘের সামনে অভিমান ফেটে বেরোয়। সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেতে যেতে বোঝে ওর হাতের ওপর ভোরের ঝড়ের ঠাণ্ডা স্পর্শ।

চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামে, আর ঝড়। অনেক ভোরের স্বপ্ন ভেঙে শীর্ষেন্দু উঠে বসে, জানলার পাশে দাঁড়ায়, না আজ আর দীর্ঘশ্বাস নয়, আজ সত্যি নেমেছে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি।

 


Leave a comment

শ্রী-” ইলিশের গন্ধটাই কেমন যেন। বড্ড আঁশটে । ভালো লাগে না একদম। ”

হবু শ্রীমতী -“সে কি? লজ্জা করে না বাঙালের সামনে বলতে? ঘটিগুলো আর খাওয়া শিখলো কই? ”

-” ইয়া ইয়া সাইজের গলদা চিংড়ির মালাইকারি, হু হু বাবা, আমি রান্না করে খাওয়াব দেখবে, কোথায় লাগে তার পাশে ইলিশ?”

-(আমতা আমতা) ” চিংড়ি ? হ্যাঁ চিংড়ি ভালো বটে। শুনেছি।”

-” কি হল? ”

– ” অ্যালার্জি ”

-“…………”

– “…………”

– ” আচ্ছা রোববার করে কষা মাংসই হবে তাহলে।”


Leave a comment

ভেজা মাটির গন্ধ

 

“আমি কোনদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি কারও সাথে কাটাইনি জানিস ? ’’ প্রথম পরিচয় ফেসবুকে, প্রথম দেখা ছিল ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে ; জিওলজি গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে নির্ঝরকে বলেছিল মেয়েটা।

নির্ঝর উত্তর দেয়নি, হালকা হেসে আলতো করে ছুঁয়েছিল কাঁধের কোণ, আর সেই পাগল করা নেশা নেশা মাটির গন্ধটা পেয়েছিল প্রথমবার, ওর চুলের থেকে। মাটির গন্ধ জানে নির্ঝর, কিন্তু এরকম মাতাল করা মাটির গন্ধ কোনদিন পায়নি ।

মেয়েটা স্নিগ্ধ হেসেছিল।

জুনের ভিজে শার্টের দুপুরবেলাতেও একপলক বরফপাত।

 

“এইটে আমার সবচেয়ে আপন গান ’’ , বলে শ্রাবণের ধারার মতো গান গেয়েছিল মেয়েটা। নিখুঁত গায় না, তবে অসম্ভব রকমের একটা মেঠো গন্ধ পেয়েছিল নির্ঝর।

“ তোর নামটা কি সুন্দর, চুপ করে  ভিজতে ইচ্ছে করে।’’ তখনও বর্ষা আসেনি মহানগরীতে, তবু মেয়েটা চোখ বুজে  দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রিন্সেপ ঘাটের থামটায় ভর দিয়ে। বড় বড় নিঃস্পন্দ একরাশ চোখের পাতায় সেদিন জিওস্মিনের গন্ধ মেখে মেঘ ঘনিয়ে এসছিল। নির্ঝর অবুঝের মতন ছুঁয়ে ফেলেছিল , ভেজা মাটির ঠোঁট দিয়ে, প্রথমবার।  মেয়েটাও।

মেয়েটা চোখ খুলল যখন…… কলকাতায় তখন রিকশাওয়ালা পলিথিনের ছাউনি টানছে , কলেজ স্ট্রীটের ফুটপাথে অপ্রস্তুত তড়িঘড়ি, উত্তর কলকাতার ছাদে শুকনো কাপড়ের তোড়জোড়ের মাঝে একরাশ স্বস্তি, ময়দানে ফুটবল পায়ে উল্লাস , স্কুলের  জানলায় আনমনা প্রথম প্রেম  …  প্রথম বৃষ্টির কলকাতা।

 

তারপর ছিল নতুন সবুজ ঘাসের ওপর খবরের কাগজ আর খালি পা , ভিক্টোরিয়াকে সাক্ষী রেখে অলিখিত  আলিঙ্গন।  উন্নাসিক মেঘের চাদরকে উপেক্ষা করে ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে বসে ছিল নির্ঝর। এককোণে তখন ধুলো আর ঝরা পাতার ষড়যন্ত্র , বিদ্যুতের লুকোচুরি । ঝড়টা আছড়ে পড়তেই মেয়েটা মুখ লুকিয়েছিল নির্ঝরের বুকে। নির্ঝর আবারও হার মেনেছিল ওই মেঘ কালো চোখের পাতার কাছে।

প্রথমবার কালবৈশাখী অভিসার । বর্ষার দিব্যি রেখে।

 

একদিন ছিল মনখারাপ ।

“ কলকাতা আর বর্ষা, শব্দ দুটো মিলিয়ে দিলে কারও কারও মনে আসে জমা জল, ম্যালেরিয়া আর ইলিশ মাছ। আবার কারও মনে হয় ঝাপসা কাঁচ , মেঘলা ছুটি , আলগা ঝড় । তুই কোন ক্যাটাগরি?’’ সিগারেটের ধোঁয়াটা  নির্ঝরের নাগালের বাইরে ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিল মেয়েটা।

নির্ঝর  হেসেছিল শুধু, “তুই? ’’

“ কলকাতা আর বর্ষা মানেই  মনখারাপ । ’’ মেয়েটা আনমনে আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বলেছিল, নিরুত্তাপ ভাবে যোগ করেছিল , “চল আজ তোর বাড়ি যাব। ’’

সেদিন চিলেকোঠায় ধুলো আর নস্টালজিয়ার আবরন, পুরনো তক্তপোশ আর ছেঁড়া তোষকের বৈরিতা । খোলা জানলার অনিয়মিত বৃষ্টির ছাঁট, তার মাঝে মিশে গিয়েছিল ঝরনা আর বৃষ্টি আর মেঠো আর নেশা নেশা আর মনখারাপের গন্ধ। নির্ঝর সেই প্রথম বুঝেছিল ওর প্রিয় ঋতু বর্ষা, স্কুলের খাতায় লেখা শরৎ নয়।

 

“আজ অফিস যাস না, কলেজ স্ট্রিট যাব চল। ’’ মেয়েটা বোধহয় খবর দেখত না।

“ আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা। জানিয়েছেন আবহাওয়া দফতর প্রধান ……” যান্ত্রিক সুরে দূরদর্শনে খবর শুনেছিল নির্ঝর। গত ভোটের পর থেকে প্রতিযোগী দুই সংবাদ চ্যানেলের দ্বৈরথে বিতৃষ্ণ হয়ে বাবা এই পন্থা নিয়েছেন।

সেদিন কলেজ স্ট্রিট ভেসে গিয়েছিল। মহাপ্লাবনের প্রাকমুহূর্তে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল মনখারাপি মেয়েটা, এককোমর কালো জল ঠেলতে ঠেলতে । নির্ঝরের মুখে তখন দিওয়ালীর প্রথম জ্বলা প্রদীপ।

সেদিন শহরের উগরে দেওয়া নৈঃশব্দ আর নিষ্প্রাণতা জলে ভেসে হেডলাইন বানিয়েছিল পরদিন। কাকভিজে দুটো প্রাণী পরিত্যক্ত বেঞ্চের কোটরে বসে সংসার সাজিয়েছিল…… কুর্তি – জিন্‌স , dunhill, টেরাকোটা কানের দুল আর ২-৩-৫ মাসের সম্পর্ক দিয়ে defined একটা মেয়ে প্রথমবার মেয়ে হলে কি নাম রাখব আবৃত্তির ফাঁকে কক্সবাজারের সূর্যাস্ত হয়েছিল, নির্ঝর মনে মনে অ্যালবামের পাতা ওলটায় আজও ।

না, এটা ঠাই পায়নি কোন লেখকের এন্ডিং লাইনের ভেতরে।

তারপর ছিল শিয়ালদা ফুটপাথ , চিংড়ির আর টম্যাটোর চপ, দুধ চা আর মেঘপিওনের লুকিয়ে পড়া চিঠির  দিস্তা।

আরও একটা বৃষ্টি হয়েছিল কুমোরটুলির একটা রংচটা সবুজ পলিথিনের তলায়। ছাতা নেয়নি সেদিন

কেউই । নির্ঝর ওই আঁধার কালো চাহনির সামনে DSLR বের করার সাহস পায়নি। ওরা কথা বলেছিল, সোমেন পাল, ভগীরথ পাল, কাঁচাপাকা দাঁড়ির গোপাল ভটচাজের সাথে। মেয়েটা একটা রুপোলী জরির মুকুটের মধ্যে চুমকি বসিয়েছিল একটা বাচ্চা ছেলের সাথে । তারপর একটা ছেলেবেলার বৃষ্টি নেমেছিল, গ্রামের বাড়ি ,খালি পা, ধানের খেত , খড়ের চালের লাউগাছ পেরিয়ে। স্মৃতিবিদ্ধ নির্ঝরের সম্বিত ফিরেছিল পুজোর গন্ধ আর মাটির গন্ধ মিশে যাওয়ায়, ওর কাঁধে রাখা মাথায় মাথা ঠেকিয়ে।

 

শেষ বৃষ্টিটা হয়েছিল অচিনপুরে । মেয়েটা সেদিন চুল খুলে এসেছিল, শ্যাওলা রঙের একটা শাড়ি। একটা বেপাড়ার বাসে জোর করে উঠিয়েছিল ঘন ঘন ঘড়ি দেখা নির্ঝরকে। তারপর আবার নেমে গিয়েছিল অচেনা  শহরতলিতে। একটা নাম না জানা মাঠ , তার পাশে সুখ – দুঃখের  দীঘি। কিচিরমিচির নিস্তব্ধতায়  ডুবে গেছিল রোজনামচা । তারপর এবছরের শেষ বৃষ্টি হয়েছিল চরাচর জুড়ে । মুগ্ধ দুচোখ জুড়ে। দুর্গার শেষ ভেজা বৃষ্টির মত নিষ্পাপ বর্ষণধারা আর ভেজা মাটির গন্ধ।

 

শরৎ , হেমন্ত , শীত । ফিকে হতে হতে প্যালেটের রংগুলো সব একে একে মুছে ধুসর হচ্ছে। গন্ধটা যেন দূরে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। এপারের না বলা ঝোড়ো হাওয়ারা ওপারের এক অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠা কাঁচের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে বিঁধছে কনকনে নিষ্ঠুর শীতের হাওয়া হয়ে।  উপন্যাসটা অনিয়মিত হয়ে হয়ে ছোটগল্পের মর্যাদাটুকুও যেন হারাতে চাইছে, নির্ঝরের মনে হল।

ডিসেম্বরে মেয়েটা এসএমএস করল , জন্মদিনের আগের রাতে। নির্ঝর তখনও ওর নিজের হাতে বানানো ক্যালেন্ডারটা রিবন আর জিজ্ঞাসাচিহ্ন দিয়ে বাঁধতে ব্যস্ত।

“ নির্ঝর আই ডোন্ট থিঙ্ক ইটস ওয়ারকিং আউট এনি মোর। সরি। ভালো থাকিস। ’’

 

অপ্রত্যাশিত ছিল না হয়তো। তবু লাগল । খুব জোর লেগেছিল।

ফোন তোলেনি মেয়েটা।

তারপর কখনও মাতাল হয়নি নির্ঝর আর ।

তারপর যেমন হয়।

পিঙ্ক ফ্লয়েড, ইনসোমনিয়া, অ্যান্টি- ডিপ্রেসেন্ট।

একটা হিমবাহর তলায় চাপা পড়ার আগের মুহূর্ত অবধি বহু অবান্তর অলীক আশার ইতস্তত বিচ্ছুরন।

তারপর একদিন বাতাসের কানে কান না পেতেও শুনতে পেল নির্ঝর অদৃশ্য আলোর রোশনাই, আর নতুন খাতায় লেখার মতো একঝাক খুশি; মেয়েটার লাল শাড়ি আর পানপাতায় ঢাকা মুখ, আর তার আড়ালে মেঘ কালো আঁধার কালো চোখ ।

 

হিমবাহ আর সারনেম নিয়ে নির্ঝর পাড়ি জমালো নিরুদ্দেশে। দশটা- সাতটা, ভিড় মেট্রো, রোববারের বাজার আর বাবার ওষুধের মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে ওঠা বিষাক্ত কলম আর লোকগীতি হয়ে।

নির্ঝর মুখোশ পড়ে নিল। আর পাঁচজন হওয়ার মুখোশ। যেই পাঁচজন মায়ের মন রাখতে যায় একের পর এক বাড়িতে, সব মৃন্ময়ীর মাঝে আঁধার কালো চাহনি খোঁজার অজুহাতে চায়ের কাপে লুকোয়ে কান্না, আর “ না আমার পছন্দ নয়” বলে মিথ্যেই ফাঁপা পৌরুষের ভান দেখায়।

 

দূরদর্শনের খবরে বলছে, এবছর ৪ঠা জুলাই  অফিসিয়াল ডেট ছিল, বর্ষা আসার, কিন্তু এখনও আসেনি। নির্ঝর টিভি টা বন্ধ করে দিয়ে চিলেকোঠার জানলায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে গর্জন, মৃদু। মেঘের। আজ আর রোমাঞ্চ বা সংকোচ , কোনটাই নেই মেঘের, নির্ঝরের কাছে। দুজনেই আজ নিরুত্তাপ, প্রশান্ত। পাশের নতুন ফ্ল্যাট থেকে “শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে’’-র আলতো শ্লেষ ভেসে আসছে। মা ছাতের টবে গাছ লাগিয়েছে। বাহারি ফুলগাছ , শৌখিন পাতাবাহার। সেই না দেওয়া জন্মদিনের ক্যালেন্ডারটা ঘরটার এককোণে ধুলোমাখা অবহেলায় ম্রিয়মান। নির্ঝর মৃতপ্রসবিত শিশুর মত ওকে তুলে আনে, পাতাগুলো উলটে উলটে আজকের তারিখে থমকায়, আজ সেই প্রথম বৃষ্টির কলকাতা  আর ভেজা মাটির ঠোঁটের রেড লেটার ডে।

টবের ক্যাকটাস এ নতুন পাতা?! ছোট, ছোট, প্রায় ইনভিসিবল , তবু পাতাই তো! আগে কোনদিন স্বচক্ষে ক্যাকটাসের পাতা দেখেনি নির্ঝর। কি একটা অসমাপ্তির অসস্তি হচ্ছে ভেতরে হঠাৎ করে।

ফোনটা পকেট থেকে বের করে নাড়াচাড়ার ফাঁকেই কেমন নিষিদ্ধ আকর্ষণের মত বেরিয়ে পড়ে M এর কনটাক্ট লিস্ট।

হিমবাহ ভাঙতে ভাঙতে একটা কল যায় নাম্বারটায়।

শেষ অক্সিজেনটুকু সঞ্চিত রাখার প্রতিশ্রুতির কয়েকটা  মুহূর্তের অপেক্ষার ওপারে ফোনের একটানা রিং এ বাধা পড়ে। একটা বহুল পরিচিত , বহুল প্রতীক্ষিত হ্যালো।

“নির্ঝর, একবার দেখা করতে পারবি? ’’ এক নিঃশ্বাসে কালবৈশাখী ধেয়ে  আসে।

চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর, কোঁকড়া চুলে জড়িয়ে যাচ্ছে কলকাতার প্রথম বৃষ্টি। নির্ঝরের হুঁশ নেই, ওর আজ আকাশ বাতাস দিগন্ত জুড়ে শুধু ভেজা মাটির নেশা নেশা গন্ধ ।

 

 


Leave a comment

নিমফল

 

“মিঠি নিমফল খাবি? ” রানা একগাল হাসল।

“ইস কি তেতো! খায় নাকি ওগুলো কেউ? তুই কি পাগল রে! ’’ মা-র জোর করে খাওয়ানো নিম-বেগুন ভাজার কথা মাথায় আসতেই মিঠির ওক উঠল।

“তুই কি বোকা। নিমফল তো মিষ্টি, নিমপাতা তেতো হয়। ’’ রানা সদর্পে বুক ফুলিয়ে জানান দিল।

“তাই?” চোখ গোলগোল করে তাকায় মিঠি।

“চল চল, ওই ঘোষেদের নিমগাছটায় উঠে আমি গাছ ঝাকান দেব, তুই নিচে দাঁড়িয়ে ফলগুলো কুড়াস। ’’

মিঠি নাচতে নাচতে চললো রানার পেছন পেছন।

“এইই আস্তে আস্তে আয় । শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ শুনতে পাবে। ’’ রানা ফিসফিস করে সাবধান করে মিঠিকে।

মিঠি অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু বাবার কিনে দেওয়া নতুন লাল বো দেওয়া জুতোগুলো এমনিতেই এত মচমচ আওয়াজ করে। মিঠির রাগ হয়, রানার ওপর না জুতোর ওপর বুঝতে পারেনা।  রানার কি ভাল, জুতো পড়তে হয় না, ওর মা বকেও না পায়ে ধুলো লাগলে । মিঠি মুখ গোঁজ করে এগোয়।

“দাঁড়া দাঁড়া, এইখানে। ’’ বলেই রানা লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে চড়তে থাকে। মিঠি হেসে ফেলে।

একটু ঝাঁকা দিতেই কত্ত কত্ত নিমফল টুপটাপ করে মিঠির গায়ে মাথায় পড়তে থাকে। খিলখিল করে হাসে ও ।

“অ্যাই , তোকে কুড়োতে বললাম না? ’’ রানা নেমে এসেছে ততক্ষণে , এসেই একটা কানমলা মিঠিকে ।

“ লাগছে ছাড় ছাড়, বাবাকে বলে দেব। ’’ মিঠি ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগে।

“বলগে যা। কাকু আমাকে লজেন দেবে, কিচ্ছু বলবে না । ’’

মিঠি কথা না বলে নিমফল কুড়োয় । রানাও অনেক জড়ো করে ময়লা হাফপ্যান্টের  পকেটে পোরে। “চল , আর কাঁদুনিবুড়ি হতে হবে না। ঝিলের পাড়ে চল। ’’ রানা হাত ধরে টান লাগায়।

দুজনে হাত ধরে দৌড়োয় । কাশীনাথের মাঠ , মিত্তিরদের বাঁশবাগান পেরিয়ে তারপর একটা পাটখেতের আল ধরে হেঁটে গিয়ে হল ঝিল।

ঝিলের পাড়ে বসে প্রথম নিমফল খায় মিঠি, খুব ঘেন্না করে। ওমা , পলকে মুখে হাসি। “কি মিষ্টি রে!’’

দেখতে দেখতে দুজনেরই কোঁচড় খালি; পা দুলিয়ে বসে কলমির ঝোপের ওপর লাল ফড়িঙের ওড়াউড়ি ।

“দাঁড়া তুই’’ বলে উঠে যায় রানা। মিনিটখানেক পরেই হাজির হয় কিসব একটা ফুল নিয়ে। সাদা , ছোট। রেললাইনের ধারে অনেক ঝোপ হয় এই ফুলের।

“এই দ্যাখ, এটা এভাবে নাকে পড়তে হয়। ঝুম্পিদিদিকে দেখেছি।’’ রানা ফুলটা মিঠির নাকে আলতো করে লাগিয়ে দেয়। মিঠি হাসে।

“তোকে না পুরো সিদেবী লাগছে। ’’ রানা চোখ মারে।

মিঠি ভয় পেয়ে যায়, টিচার বলেছে চোখ মারা খুব খারাপ জিনিস।

 

 

 

“এইটুকুন খেয়ে নাও তিতির, স্কুলে টপ করতে হবে তো। আর তারপর সুইমিং ক্লাস,… ’’

“না আর খাব নাআআআ! ’’ তিতির টেবিল থেকে উঠে দৌড় লাগায় , এখন চলবে ডাইনিং জুড়ে ছোটাছুটি , একজন মুখে খাবার নিয়ে, আরেকজন প্লেট হাতে। এক নিয়ম রোজ। ভালো লাগে না মিতালির।

“বাবান বাবান …” লাফাতে লাফাতে তিতির গিয়ে জড়িয়ে ধরে সঞ্জয়কে।

“ওলে বাবা লে, আমার পুচু সোনাটা খেয়েছে? ’’

“ সেই শান্তি কি আমার আছে? ’’ মিতালি গুমরোয় পাশ থেকে।

“খেয়ে নাও সোনা, নাহলে কি করে taller, stronger, sharper হবে? ’’ তিতিরকে কোলে তুলে বলে সঞ্জয়।

“ বাবান মা আজকে আবার আমায় papaya খাওয়াচ্ছে। ’’ তিতির কমপ্লেন জানায়।

“ ওকে, আমার সোনাকে খেতে হবে না papaya, আর আমার সোনা আজকে আমার কাছে খাবে। ’’

তিতিরের হাততালির মধ্যে সঞ্জয় মিতালির হাত থেকে প্লেটটা ছিনিয়ে নেয়।

“মেয়েটার সামনে atleast normal behave….’’ মিতালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় দ্রুত।

আজ ১০:৩০ টায়ে  ফার্স্ট ক্লাস, মেয়েকে স্কুলে ড্রপ করতে তো মিতালিকেই হবে। কোনদিন দায়িত্ব নিয়েছে সঞ্জয় একফোঁটাও ? মেয়ের ৪ মাস বয়স থেকেই তো উনি ওদেশে , ওকে স্কুলে ভর্তি, নিজের কলেজ, কম সামলেছে একার হাতে মিতালি ? এখন ইন্ডিয়াতে ফিরেও কি একদিনও সংসারে এতোটুকু contribute করেছে? আর এখন তো, থাক ওসব।

বডি ওয়াশের নরম গন্ধ আর ঈষৎ উষ্ণ শাওয়ারের জলে ডুবে যেতে থাকে সারারাতের ক্লান্তি।  হাঁটুর কাছে আর ঘাড়ের কোণে এখনও কালশিটে । জ্বালা করছে সাবানজল লেগে। মিতালি দাঁত চেপে থাকে। তিতিরটা আরেকটু বড় হোক।

ফ্ল্যাটের পেছনে ফাঁকা জমি আগাছার ঝোপে ভরে আছে। কোথা থেকে একটা জংলা পারথেনিয়ামের গন্ধ সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে ভেসে আসছে। মিতালি হারিয়ে যায় , অতলে।

 

 

“ বাবা মিঠিকে টিভিতে দেখলেন? ওই মাধ্যমিক রেজাল্টের পর? ’’ মা দাদুকে প্রনাম করতে করতে বলে।

“হ্যাঁ গো বউমা, দেখলুম মিঠিসোনাকে । ’’ দাদু মিঠির মাথায় শীর্ণ হাত বুলিয়ে দেন।

“দিদিভাই, নাড়ু খাবি? ’’ ঠাম্মা ডাক পাড়েন দরজার আড়াল থেকে।

“তিলের নাড়ু আছে ঠাম্মা? ’’ মিঠি হরিনপায়ে অদৃশ্য হয় পর্দার আড়ালে।

“ দেখেছ? আরে মেয়েটা , স্নানটা করে নে তো! কতক্ষণ ট্রেন জার্নি করে এলো… কোন বুদ্ধি আছে? ’’

“থাক বউমা, কতবছর পরে এলো বলো তো মেয়েটা। ’’

“হ্যাঁ দু বছর প্রায় ।’’ বাবা জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে উত্তর দেয়।

 

দুহাতে চারখানা নাড়ু নিয়ে মিঠি চুপিচুপি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পরে। এখন ভরা রোদ, কিন্তু দাদুদের এই আমবাগানটা সারাবছর ছায়া ছায়া। পাকা পাকা সিঁদুরে আম ঝুলছে সব গাছ থেকে। ধুর এত্তদিন এই পড়া পড়া করে আটকে রেখেছে মা বাবা, মনটাই ভালো হয়ে যায় এখানে আসলে।

মাটির রাস্তাটার শেষে বাদিকে রানাদের ঘর । টালির চাল, ছিটেবেড়ার দেওয়াল। উঠোনে এক কোণে বাতিল ঝুড়ি , প্লাস্টিকের কাপ,বালতি ডাই করে রাখা, আরেকদিকে ওদের পোষা হাঁসের ঘর। কত খেলেছে মিঠি ওদের উঠোনে। আর ওর মা কি দারুণ রসুনের আচার বানায়। মাঝে মাঝেই মা কে না বলে রানার সাথে বসে শাপলা, কচু , আচার , লঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছে কত! আজকে সেসব মনে পড়ে খুব খুশি লাগছিল মিঠির কেন জানি।

 

দুবছর আগে একদিন বিকেলে রানার সাথে সেই ঝিলে গেছিল মিঠি। রানার বন্ধু বিলু, ওর বাবা মাছ ধরে। একটা ডোঙা ভেড়ানো  ছিল পাড়ে, বিলুর বাবার। খুব সন্তর্পণে উঠেছিল দুজনে, একটু এদিক ওদিক করলেই সোজা জলে। রানা ওপাড়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওপাড়ে পুরো অন্য আরেকটা জগৎ যেন। তখন পুজো সবে শেষ হয়েছে, ত্রয়োদশী ছিল বোধহয়। আকাশটা মিঠি আঁকার স্কুলে যেমন শিখেছে , পুরো সেরকম ছিল, ওপরে vermilion আর নিচে chrome yellow. মিঠি সোৎসাহে রানাকে রঙগুলো চেনাচ্ছিল। রানার যদিও সেরম একটা আগ্রহ নেই। ওপাড়ে নামতেই , দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের বন… হাত কেটে গেছিল মিঠির কাশের ধারালো ঘাসে , রানা সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখে পুরে নিয়েছিল ওর আঙুলটা, মিঠির মনে আছে। আর তার মাঝে ছিল একটা বড় শিরিষ গাছ। তার তলায় রানা মিঠিকে একটা কাঁচের গ্লোব মতন জিনিস দিয়েছিল, তার ভেতরে জলের মধ্যে চিকচিকি, একজোড়া সাহেব মেম, বলডান্স করছে।

“ মিঠি এটা তোর জন্য। রথের মেলা থেকে কিনেছি। ’’ রানা বেশ গর্বের সাথে বলে, “ নিজের টাকায়।’’

“ওমা, কি সুন্দর রে!’’ মিঠির খুব সুন্দর একটা মিউজিক বক্স আছে, খুললে মিউজিক বাজে, আর বলডান্স করে দুজন, ছোটমামা দিয়েছে দিল্লি থেকে। কিন্তু এটা যেন আরও সুন্দর তার চেয়েও। সস্তার গোলাপি রিবনে মোড়া , কিন্তু কি সুন্দর একটা আভা বেরোচ্ছে যেন ওটা থেকে।

মিঠি ফস করে কি মনে হয়, রানার গালে একটা চুমু খেয়ে বসে।

রানা চমকে ওঠে।   মিঠি খিলখিল করে হেসে ওঠে।

“রানা জানিস এরা দুজন কি করছে? ’’ মিঠি খোঁচায় ।

“কি আবার? নাচ! ’’ রানা মুখ নামিয়ে আঁকিবুঁকি কাটে মাটিতে।

“ উঁহু, এটাকে বলে বলডান্স। শিখবি? ’’

“ তুই জানিস? ’’ বিস্ময়ে হা করে তাকায় রানা।

“ হ্যাঁ তো, অ্যানুয়াল ফাংশানে আমি আর অঙ্কুশ পারফর্ম করেছিলাম একটা নাটকে । ’’

“অঙ্কুশ কে? ’’ রানা চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করে।

“ কে আবার?  আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার পাশে বসে সবসময় ক্লাসে। ’’ মিঠি মিষ্টি হেসে বলে।

হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে যায় রানা।

“চল বাড়ি চল। দেরি হলে সবাই খুঁজবে আমাদের।’’ রানা ডোঙাতে উঠে দাঁড়ায়।

মিঠি ঘাবড়ে গিয়ে ওর পিছু পিছু যায়।

পাড়ে ফিরতে না ফিরতেই দূর থেকে বাবা মা আর রানার বাবা দিনুকাকুকে চোখে পড়ে । সবার মুখে আষাঢ়ে মেঘ।

দিনুকাকু রানাকে সেদিন মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। বাবা মায়ের “কতবার বারণ করব এখন বড় হয়েছ, যার তার সাথে যেখানে খুশি যাবে না… কলি, ঋত্বিক, সুহানা ওদের সাথে মেশো , আর কত বন্ধু চাই?…’’ শুনে কান্না পায়নি ওর, মিঠির কান্না পেয়েছিল রানা একবারও মুখ ঘুরে তাকালো না বলে।

 

“কাকিমা? ভালো আছ ? ’’ মাধ্যমিকে কলকাতায় টপার মিতালি উঁকি মারে ঘরের ভিতর।

“কে? ওমা, আমাদের মিঠিরানি? কবে এলি মা? ’’ রানার মা ছুটে আসে দেখতে পেয়ে। ছেঁড়া শাড়িতে  তিন জায়গায় তাপ্পি।

“আজকেই।’’

“ আয় মা বোস। তুই কত ভালো রেজাল করলি রে, টিভিতে দেখালো। সবাই দেখলাম গ্রামের লোক মিলে, নে মা মোয়া খা। ’’ কাকিমা মোয়া ধরিয়ে দিল মিঠির হাতে একটা।

“রানা কই? ’’

“রানা তো একন ওর বাবার সাথে টাউনে যায়, ওই হাতে হাতে জোগাড়ের কাজ করে দেয়। ’’ রানার বাবা দিনমজুর। “ এই তো ফিরবে আরেকটু পরেই, বোস। ’’

“না কাকিমা আজ আসি, পরে আবার আসব। ’’ মিঠি উঠে পড়ে।

 

সেবার আর যাওয়া হয়নি রানার বাড়ি। কিন্তু দেখা হয়েছিল রানার সাথে। একদিন খুব সকালে, কাকডাকা ভোরে। রানার  “ কেমন আছিস? খুব ভালো রেজাল্ট করলি তো”-র ফাঁকে দুফোঁটা চোখের জল মিশে ছিল, মুছিয়ে দিতে সাহস হয়নি মিঠির।

 

তারপর দাদু চলে যাওয়ার পর গিয়েছিল দেশে। বিষণ্ণ এককোণে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন হেসেছিল ওর দিকে তাকিয়ে। তাল কেটে গিয়েছিল সঞ্জয় ফোন করাতে। মিঠির বয়ফ্রেন্ড।

আর তারপর শেষ যাওয়া সঞ্জয়ের সাথে বিয়ের একমাস আগে। আইবুড়োভাত খাইয়েছিল কাকু-কাকিমা। কোন দিনমজুরের ছেলের খোঁজ পড়েনি আর।

 

 

কাল রাতে আবার মিতালির গায়ে হাত তুলেছে সঞ্জয়। এই নিয়ে ৪-৫ মাস হল চলছে। রেগুলার। ওর ফোনে আপত্তিকর মেসেজগুলো দেখেছিল ঠিক ৩ মাস আগে, সন্দেহ যদিও আগের থেকেই ছিল। confront করলেই সেটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেত। অতবড় রাক্ষুসে লোকটার সাথে পেরে উঠবে কি করে মিঠি?

বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলে জোর করে মিলিত হওয়ার চেষ্টা। সঞ্জয়টাকে আর মানুষ বলে মনে হয় না মিতালির।  এত ছোট একটা মেয়ে থাকতেও যার আরেকজনের সাথে সম্পর্ক , তাকে আর…

 

কিন্তু সেদিন লিমিট ক্রস করে গেল সঞ্জয় , মেয়ের সামনেই মিতালির গায়ে হাত তুলল । মেয়েটা পুরো দিনটা ভয়ে কান্নাকাটি , ঘর থেকেই বেরোতে চাইছিল না।  মিতালি অনেক সহ্য করেছিল, মেয়ে বড় হোক আরেকটু, কিন্তু এরপর আর মনে হয় দেরি করাটা সমীচীন নয়।

সেদিন দুপুরে মেয়েকে কোলে নিয়ে জানলার ধারে ঠায় বসে ছিল মিতালি।

“মামমাম , তুমি কি দুষ্টুমি করেছ? তাহলে বাবান তোমাকে মারল কেন? ’’

“হ্যাঁ তিতির, আমি খুব একটা বড় দুষ্টুমি করেছি, তাই বাবান খুব বকে দিয়েছে আমাকে।’’

“এমা, মামমাম দুষ্টু , মামমাম আমার থেকেও দুষ্টু।’’

মিতালি চুপ হয়ে থাকে । তিতির বকবক করতে করতে ওটা কি পাখি, ওটা কি ট্রি তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অচিরেই। সত্যিই তো , মামমাম কি কোনদিন তাকে কোলে করে বসে আর জানলা দিয়ে পাখি গুনেছে?

“ ওটা নিমগাছ তিতির , ওই যে খুব তেতো হয়, তোমাকে একবার খেতে হয়েছিল যখন তোমার পেটব্যাথা হয়েছিল, মনে আছে? ’’

“ ইয়াক, ওটা খুব বাজে। মামমাম দ্যাখো ক্রো টা ওই ফ্রুটটা খেতে যাচ্ছে, কি বোকা কাক টা। এই কাক যা যা, শুঃ ! ’’

মিতালি চমকে ওঠে। নিমফল! না রে পাগলি , তেতো নয় রে, তেতো নয়।

 

 

চশমার ঝাপসা কাঁচের আড়ালে দুজোড়া উজ্জ্বল চোখ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মিতালি। মেয়েকে কোলে নিয়ে।  IRCTC-র সাইট । অনলাইন টিকেট বুকিংটা সেরে ফেলতে হবে, সেই স্বপ্নের দেশটার।

 

যেখানে নিমফল আর পারথেনিয়াম আর কলমির গন্ধে সুখের স্বপ্ন দেখা যায়। যেখানে দিনমজুরের ছেলে রাজা আর মিঠিরানি ঘর বাঁধে শাল-শিরিষের ছায়ায়।

472

 

 

 


Leave a comment

কাটাকুটি

“আজ এই LBD টা পরব কিন্তু। What do you say?” ওয়ার্ডরোবের ভেতরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে শালিনীর জড়ানো আওয়াজ টা নীলের কানে পৌঁছেও পৌঁছল না । আজ মন ভালো নেই নীলের, যেই ম্যাগাজিনের সাথে লাস্ট ৪ মাস কাজ করছিল, ইন্টার্নশিপ, আজ ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ওর দোষ ও কাজে হোক জীবনের ক্ষেত্রে হোক কিছু বেসিক এথিকস মেনে চলে। তথাকথিত urban reader এর চাহিদা অনুযায়ী ও পারেনি ওর সিগনেচার কাজগুলো একের পর এক made up, মুখরোচক আর্টিকেলএ ব্যবহার করা টা মেনে নিতে। আজ তাই ডেকে অপমান করে কাজের অযোগ্য বলে তাড়িয়ে দিয়েছেন রাহুল স্যার, বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার ।একদিন যার সাঙ্গ পেয়ে জীবন ধন্য ভেবেছিল, আজ তার বাঁকা হাসিটা বিষিয়ে দিচ্ছে ভেতর টা। আনমনে শালিনীর নতুন পাওয়া ফ্ল্যাটের সুদৃশ্য কাঁচের সেন্টার টেবিলে আঁকছিল নীল, একটা কাটাকুটির ছক। নিজেকে কেমন মনে হচ্ছিল সেই লম্বালম্বি আর কোণাকুণি দুভাবেই অনেক অদৃশ্য ক্রসের মাঝখানে থমকে যাওয়া একটা অসমাপ্ত বৃত্ত।

ঊফফ শালুক , একটু নিজে decide কর না! নীল গজগজ করে অস্ফুটে। আজ ওদের এক বছর, celebrate করা হবে Marco Polo তে, শালিনীর নতুন পাওয়া প্রমোশনেরও উদযাপন।

“এই দাঁড়া দাঁড়া, LBD কেন?” বলতে বলতে নিজেই উঠে যায় নীল।

নীল চেয়েছিল ওদের একমাসের দিনের মত সেই বাসা হারানো দুটো পাখি হয়ে, অচেনা রাস্তা ধরে, অজানা বাসে চেপে বসে, অনির্দিষ্ট সেইরকম একটা পুকুরপাড়ে বসে কনে দেখা আলোয় এলোমেলো চুলের আদরে উচ্ছলিত শালুকের একটা দুটো ছবি নিতে , আর ছোট্ট কিছু আলগোছ ব্যারিকেড, ঠোঁটের ভেতর ঠোঁট। শালিনীর বিরক্তির সঙ্গে খেলা কাটাকুটি তে হেরে গেছে নীল, কে জানে কেন। তাই আজ Marco Polo।

“কেন? খারাপ কিসে?” শালিনী রেগে যায়।

শালিনী কে নীল এখনও জানায়নি, ওর জব টা চলে যাওয়ার কথা।

বুকের কোথাও একটা ভীষণ চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে; চেনে নীল এটা কে। ঠিক এরকমই হয়েছিল মা যখন শয্যাশায়ী, যেদিন ভোরে মা চলে গেল, তার আগের রাতে। ঠিক এরকমই ব্যথা হয়েছিল ওর পোষা টিয়া একটু অসাবধানের সুযোগ নিয়ে উড়ে যাওয়ার আগে। যাক ওসব, নীল নিজেকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।

“ব্যাঙ্গালোর থেকে ওই নীল শাড়ি টা এনেছিলি , ওই টা পর না , তোকে অসম্ভব সুন্দর দেখায় !” নীল আলতো কামড় বসায় ওর কানে।

“ইস কত শখ ছেলের । যা তো, আমাকে রেডি হতে দে।“

“ওয়েট শালুক , you know what to do!” নীল চোখ টেপে।

“নীল , not now! We are already late!” শালিনী সযত্নে কেয়ারি করা ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত ভাবে তাকায় , কোথাও একটা না’বলা ভেসে আসে, “ডিসগাসটিং!”।

নীল ততক্ষণে পেন দিয়ে নিজের হাতে একেও ফেলেছে, ছোট্ট একটা কাটাকুটির ছক।

“শালুক, তুই তো ক্রস!”  নীল এর চোখের কোণ ভিজে এসেছে আজ।

ছেলেটা মেট্রোর দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে একমনে হাতে আকিবুকি কাটছিল। শালিনী সিটে বসে, ফাঁকা ট্রেন বাস মেট্রোয়ে মানুষ কে খুটিয়ে observe করা তার অভ্যেস । শালিনী আনমনা ছিল, সদ্য ব্রেক আপ, বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টার প্রছন্ন একটা আভাস কালকেই পেয়েছে মা বাবার চাপা আলোচনায়।

ছেলেটা কেমন অদ্ভুত, একবার কিসব আঁকছে হাতে, আবার ঘষে পেন দিয়ে তুলছে আবার আঁকছে। কোঁকড়া চুল টেনে একটা পনিটেল করা। একটা খাদির কুর্তা আর নীল ডেনিম পরনে। টিপিক্যাল আতেল। শালিনী-র কৌতূহল হল , অযাচিত। সামনেই নামবে ও, উঠে দাঁড়ালো।  এক ঝলক উঁকি মারারও ইচ্ছে এই ভরদুপুরি artist এর শিল্পকর্মে।

ওমা! কি অদ্ভুত! একা একা আবার কাটাকুটি ও খেলা যায় নাকি? আজব ছেলে তো!

একটা অসমাপ্ত ছক, এখনও ৪টে দান বাকি।

কি করছে লোক টা? ধুরর পাগল টাগল নাকি?

ইস বা দিকের কোণে ক্রস টা না বসিয়ে ডান দিকের নিচের কোণে বসাতে পারত!  জেতার দান!

ধুরর একী? একা একা কি বোকার মতন খেলছে লোকটা! আর শালিনীও কিনা তার এই খামখেয়ালিপনায় মশগুল? কি যে হয় মাঝে মাঝে!

“Station রবীন্দ্র সরোবর” যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর এর জানান ভেসে আসতেই হাত থেকে কালো পেন টা পড়ে  গেল ছেলেটার। শালিনীর  সামনেই। খানিক ইতস্তত করেও নিচু হল পেন টা তুলতে।

ছেলেটার অবাক কেমন চমকে যাওয়া দৃষ্টি উপেক্ষা করেই শালিনী হাত বাড়াল পেন টা ফিরিয়ে দিতে। বা হাতের উন্মুক্ত ছকটা দেখে কেমন একটা বেপরোয়া খেয়াল হল শালিনীর। মুহূর্তে শেষ ক্রস টা বসিয়ে দিল সঠিক কোণটায়ে , একটা ভীত-লজ্জিত বিজয়ীর হাসি নিয়ে নেমে গেল অটোমেটিক দরজা দিয়ে। পেছন ঘুরে দেখল ছেলেটা মুখ নামিয়ে ছকটা দেখছে, ফর্সা গালে একচিলতে লালের আভা যেন।

তারপর ছিল কয়েকটা দিন, কয়েকটা থমকে যাওয়া ফাঁকা মেট্রোর পড়ন্ত বিকেল, আর কয়েকটা কাটাকুটির ছক। জিতুক,হারুক, কোনদিন ক্রস নেওয়ার ব্যতয় হয়নি শালিনীর।

নীল সেনগুপ্ত তখন ফ্রীলান্স কাজ করছে, ফটোগ্রাফি। বেখেয়ালি, আধপাগল, প্রচণ্ড লাইভলি ছেলেটায় মজতে বেশিদিন লাগেনি শান্ত, তীব্র careeristic শালিনীর।  কদিন খুউব খুব পাগলামি করে, ডানা ঝটপটিয়ে কেটে গেছিল দুজনের। ফোঁড়ন এর ঝাঁঝ টা কাটতেই কেমন একটা মিশ খাচ্ছিল না যেন সবকিছু, শালিনীর মনে হতে থাকল।

নীলের সবচেয়ে বড় পাগলামি, যেই জিনিস নিয়ে শালিনীর সঙ্গে অনেক তর্ক – বিতর্ক করেও কিছু decide হচ্ছে না, সেটা শেষমেশ মেলানো হবে কাটাকুটি দিয়ে। প্রথম দিকে শালিনী নিজেই হেসে হেসে বলত, দাঁড়া দাঁড়া , আর এঁকে ফেলত একটা চেনা ছক, সেটা নীলের হাতের ওপরেই হোক বা নিজের ফ্রেশ assignment এর শেষ পাতায়। তারপর ধীরে ধীরে ওর শালুকের  উৎসাহ টা দায় সারায় পরিণত হল, আজকাল নিতান্তই বিরক্তি, বোঝে সেটা নীল।

Jouralism এ গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কয়েকমাসের মাথায় স্রেফ প্রচণ্ড চেষ্টা আর উদ্যমের জেরে একটা  leading সংবাদপত্রে চাকরি টা পেয়ে যায় শালিনী। উপরে উঠতে বেশি সময় লাগেনি ওর, অসম্ভব পরিশ্রমী আর ফোকাসড, চেনে ওকে নীল আর মনে মনে গর্ব হয় সত্যি, তার শালুক কে নিয়ে। তার Work hours এ কল বা মেসেজ পাঠানো strictly নিষেধ। যখন দিনের শেষে ফাইনাল এডিটিং চলছে, বা যখন বস অয়ন ব্যানার্জির সঙ্গে “confidential session” চলছে তখনও। “ শালুক তুই আরও পারবি দ্যাখ, অনেকটা রাস্তা বাকি এখনও তোর,” নামী রেস্তরা বনাম ময়দানের সেই পিপুল গাছ টার কাটাকুটি তে হেরে গিয়ে বলে যায় নীল, অমলিন।  শালিনী আলতো হাসে, মলিন, ধরা পরে যায় নীলের আচমকা স্ন্যাপে।

একটার পর একটা ছোটবড় কাজ ছেড়েছে নীল, শুধুমাত্র ওর এথিকস, বা ওর কাজের ধরনের সাথে খাপ না খাওয়ায়, বা নিছকই খেয়ালিপনা ওর। এর মধ্যে কয়েকটা এক্সিবিশন হয়েছে ওর ফটো নিয়ে, বেশ নামডাক ও হয়েছে, কিন্তু নীল আজও ভবঘুরে, খেয়ালি, আধপাগল; ঠিক প্রথম দিন টার মতনই। শালিনীর নিউজপেপারেই একটা ভাল অফার এসছিল নীলের, “শালুক is right. একসাথে কাজ করলে আর কাজ হবে না সারাদিন।“ নীল মনে মনে লাজুক হাসে। শালিনীর নতুন ফ্ল্যাট টায় কেমন দমবন্ধ লাগে ওর, বলেনি শালুক কে।

শালিনী অনেকদিন ধরেই ভাবছে বলে ফেলবে, কিন্তু ছেলে টা এখনও এত সরল, বাচ্চামো করে, কিছুতেই বলে উঠতে পারেনি শালিনী, প্রায় দেড় মাস হতে চলল। নিজের মনেও একটা শীতের বিকেলের কমলা-হলুদ রোদের মত খারাপ লাগা আছে, কিন্তু কোন মানেই খুজে পাচ্ছে না আর এই বোকা বোকা রিলেশন টা টিকিয়ে রাখার। অয়নের সাথে সম্পর্ক টা কদিনে বেডরুম বা অফিস রুমের বাইরে বেরিয়ে বেশ গাঢ় হয়েছে, বুঝতে পারছে ও। অয়ন সাংঘাতিক careeristic, non-comprising, practical একজন, শালিনীর মতই। কতই বা বড় শালিনীর চেয়ে, hardly ৭-৮ বছর, এখনই দু-দুটো লাক্সারি কার, second ফ্ল্যাট টাও বুকিং done।

Shit! দেখতে দেখতে anniversary টাও চলে এলো, শালিনী বেমালুম ভুলে গেছিল, নাহলে এতদিন linger করতই না ব্রেক আপ টা করতে। সেদিন দুপুরে নীলের ছোট পায়রার খুপচির মত ফ্ল্যাট টায় খানিক শরীরঘন হওয়ার পর শালিনীর চোখ পড়ে যায় টেবিল ক্যালেন্ডার টায়। ওদের দিন টা লাল গোল করে পাশে কাটাকুটি লেখা, আর একটা চেনা ছক আঁকা ।

আজ একটুও ইচ্ছে নেই শালিনীর যাওয়ার, তবু খারাপ লাগা টা কে এক ফুয়ে নিভিয়ে দিয়ে আজ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যা হওয়ার হোক, আর আটকে রাখবে না নিজেকে এই baseless সম্পর্ক টায়।

Taxi তে যেতে যেতে বুকের চিনচিন ভাব টা বাড়ছিল নীলের, আভাস কিছু একটা পাচ্ছিল ও। LBD তে ভীষণ লাস্যময়ী লাগছিল শালুক কে। নীলের চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল,  মোবাইলে নিমগ্ন শালুক কে দেখে।

CandleLight Dinner এর শেষ কোর্সে নীলের বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে একটু দূরে হাত টা রেখে শালিনী casually জিজ্ঞেস করেছিল, কাজকর্ম কেমন চলছে? নীল বলেই দিল, জব টা আর নেই ড়ে শালুক, ওই রাহুল মাল টা এত ছোটলোক জানিস…”

“আহহ নীল, এটা একটা ভদ্র elegant place। ঠিকঠাক বিহেভ করতে না জানলে আসিস না এসব জায়গায়। “ শালিনীর বিরক্তি টা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। আর দেরি করেনি ও, বলেই দিল।

নীল জানত, জানতই ও। তাই আজকেও প্রথম দিনের মত অমলিন হাসল একটু।

“শালুক, যেতে দেব না তোকে, দেবই না” , হঠাৎ ছাইচাপা আগুনের মত ফুঁসে উঠল নীল। শালিনী চমকে উঠল। “নীল বোঝ তুই, আর কতদিন ছেলেমানুষি করবি?”

“না শালুক, I wont, I just wont let you go” , নীলের স্বরে চাপা গর্জন।

শালিনীর আর পোষাচ্ছিল না এই embarrassing melodrama টা। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

“শালুক, যাস না, প্লিজ।“ এসব চোখের জলটল অসহ্য লাগে শালিনীর।

“শালুক, প্লিজ, আর একবার , এই খেলা টাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দে শালুক, আজও।“

শুধুমাত্র scene create করা টা কে আটকাতে শালুক রাজি হয়েছিল সেদিন। ওর রুমাল টায় নীল এঁকে ফেলেছে ততক্ষণে। ১৫ সেকেন্ডে জিতে গেল শালিনী। easy win।রুমাল টা টেনে নিয়ে ঝোরো হাওয়ার  মত বেরিয়ে যেতে যেতে শুনেছিল একটা ভেঙ্গে পড়ার আওয়াজ।

আজকাল এত ব্যস্ততা, নিজের report গুলোর বাইরে আর নিউজ গুলো সেরকম দেখাও হয়না। অয়ন এখন senior editor, editing এও হেল্প করে শালিনী প্রচুর।

আজ দুপুরে অয়নের অফিসে তলব পড়ল। অনেকক্ষণ আদরের পর অয়ন কয়েকটা নিউজ একটু দেখে নিতে বলল শালিনী কে। শেষ খবর টায়ে থমকে গেল শালিনী, সেই অনেকদিন আগের বিকেলবেলার মেট্রো তে সময় যেমন থমকে গেছিল কাটাকুটির ছকে। স্বল্পখ্যাত ফ্রীলান্স ফটোগ্রাফার নীল সেনগুপ্তর মৃত্যুর খবর। ড্রাগ ওভারডোজ।

মন টা ভারি হয়ে ছিল কেমন সারাদুপুর। বিকেলে তাই অয়নকে বলল বাইরে খেতে যাবে কোথাও। ওয়ারড্রবের থেকে একটা নীল শাড়ি বের করে পড়ল শালিনী।  পুরনো একটা রুমাল ফেলে রেখেছিল এক কোণে, একটু ইচ্ছে করেই। বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল খানিক, আর হঠাৎ মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি নামল জানলার কাঁচে। মেক-আপ টা ধুয়ে যাবে, এটা বুঝে সামলে নিতে নিতে চোখ পড়ল রুমালটার ওপরের ছক টায়।।

একী!!! ডানদিকের নিচের কোণে একটা গোল বসিয়ে দিলেই তো শিওর জেতা ছিল। শালিনীর জেতার দানের ঠিক আগের চাল টা, তা না করে ও মাঝখানে বসাতে গেল কেন? মানে? তবে? আমার ক্রস? এতদিন প্রায় একটাও গেম এ না জেতা?? কোনদিন তো লক্ষই করেনি শালিনী! নিস্পাপ কিছু জেতার আনন্দ বা পরের দিকে একরাশ বিরক্তির মাঝে একদিনও তো দ্বিতীয়বারের জন্য তাকিয়ে দেখেনি ছক গুলো তে !! নিজে সবসময় ক্রস নিত, একটা নিষ্ঠুর আনন্দ ছিল ওই বোকা বোকা idiotic দেখতে গোল গুলো কে সরিয়ে দেওয়ায়। আজ তো ওরা হেরেও হারিয়ে দিল। এবার কোথায় যাবে শালিনী ? চিরকাল কাটতে শিখে এসে আজ যে বৃত্ত তে আটকা পরে গেল, কিভাবে বাঁচবে শালুক?  জানলার কাঁচে গভীর মেঘের ছায়ায় একজোড়া বিস্ফারিত চোখের জলছবি ধরা পড়ল না।

tic tac toe