ভুল রাস্তার মোড়ে


Leave a comment

নস্টালজিয়া- ১ আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড

এখন যতই আমার শহর, ভেজা কাঁচের ওপারের হ্যালোজেন, নস্টালজিয়া নিয়ে রোম্যান্টিসিজম করি না কেন; আমার ছোটবেলাটা কিন্তু শহুরে হতে হতেও হয়নি… আর তার জন্য এখন খুব নিশ্চিন্ত লাগে।

আমরা থাকতাম সাউথের এক কলোনি এলাকার একটা ভাড়াবাড়িতে। বাড়িটার বাইরের রংটা ছিল অদ্ভুত একটা শ্যাওলাটে গোলাপী, একতলার যে দুটো ঘর জুড়ে থাকতাম সেখানে ছিল হালকা সবুজ। একটা ঘরের দেওয়াল জুড়ে ছিল অ্যাবস্ট্রাক্ট মিউরাল। না ভাই, ওটি কচি আমির শিল্পকর্ম । ক্রেয়নের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আঁকার স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে অবধি চলেছিল সেটা। তালগাছ থেকে গুপী-বাঘা, মা বাবা থেকে প্রথম দেখা পুরীর সমুদ্র কেউ বাদ যায়নি।

বাড়িটার সামনে পেছনে জুড়ে অনেকটা জায়গা ছিল। অযত্নলালিত একটা বাগান আর অচেনা গাছপালায় ভর্তি। দেশের বাড়িতে অনেক বড় জায়গা, বিশাল আম-জাম- কাঁঠালের বাগান থাকা সত্ত্বেও কেন জানি ওই শহুরে নামের আড়ালে ফিক করে মুচকি হাসা বাগানটা অনেক বেশি আপন ছিল।
যদ্দুর মনে পড়ছে, সামনের ক্যাঁচ করে আওয়াজ করা বড় লোহার গেটটার সদর দরজা বরাবর রাস্তাটা ছিল বাগানের বুক চিরে । আর ওই রাস্তার দুপাশে ঠাকুরপুজোর সাদা ফুল, অসম্ভব একটা বেগুনি নীলকণ্ঠ ( যেই প্রজাতি আমি সারাজীবনে আর কোথাও দেখিনি) , লাল আর ক্রিম রঙের জবা, স্থলপদ্ম , কলাবতী আর অনেক পাপড়ির একটা গোলাপ গাছ ছিল। এককোণে খুব নিচু একটা তুলসীবেদি। লাল সিমেন্টে বাঁধানো। আর বাগানের মাঝখান জুড়ে ছিল একটা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো গোলাপি জবার বিশাল গাছটা । মূল কাণ্ডটা এমনভাবেই বেঁকা ছিল যে ছোট্ট আমি বাড়িওয়ালা জেঠুর হাজার বারণ সত্ত্বেও লুকিয়ে সেখানে বসে দোল আর ম্যাঙ্গো বাইট খেতাম। আর ছিল একটা অব্যাবহৃত সিমেন্টের কুয়ো , যার স্থবির জলে সবজে আলো ফেলত ওই জবাগাছ আর একটা কাগজিলেবু গাছের একসাথে সুখে সংসার করা পাতারা। যখন একটা চাইনিজ কাট চুলের দুষ্টুমিতে ভরা মুখের প্রতিবিম্ব পড়ত সেই মায়ানগরীর আয়নায়, তার গভীর কৌতূহলী চোখে কুয়োর ভেতর থেকে চেশায়ার ক্যাট বা হোয়াইট র্যা বিটের দেখা পাওয়ার অপেক্ষা।

মায়ের হাজারো বারণের মধ্যে অন্যতম ছিল কুয়োয় উঁকি দিবি না। বলা বাহুল্য , তাঁর দুপুরের ঘুমের সুযোগ নিয়ে চুপি চুপি দরজা খুলে সেটিই করা হত। শেষে দেখানো হল ছেলেধরার ভয়। যারা তোষক- বালিশ বানানোর তুলো ধোনার যন্ত্র নিয়ে হাঁক পাড়তেন পাড়ার মাঝে, কেন জানিনা মনে গেঁথে গেছিল তারাই ছেলেধরা। আর ভয় পেতাম কেজিদরে কাগজ কেনার লোকগুলোকে দেখে, বোধহয় ওই সঙ্গের বড় বস্তাটা দেখেই । এমনকি, প্রথম যেবার হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার গল্প শুনলাম বাবার কাছে, মনে মধ্যে ছবিটা সেই ফিরিওয়ালাদেরই একজনের ছিল।

বাড়ির বাগানটা যেন ছিল হারমিওনির সেই ব্যাগটা। সকালে পুজোর ফুল লাগবে তো গাছে হাজারো রকম ফুলের বাহার সারা বছর জুড়ে। টগর , কেতকী, করবী, গন্ধরাজ(ফুল) , লঙ্কাজবা, শুয়োপোকাদের হাউসিং কমপ্লেক্স হওয়া একটা শিউলিগাছও ছিল। শিবরাত্রি তো ধুতরো , আকন্দ, নীলকণ্ঠ সব মজুত। দুপুরে ডাল ভাত তো গাছের থেকে লেবু পেড়ে আনো। কাশি হচ্ছে তো বাসক-তুলসীর রস নিমেষে রেডি । বাড়িওয়ালা এক দিদা তো মাঝে মাঝেই পুঁই , কুমড়ো , লাউ ইত্যাদি গাছ লাগাতেন, রেঁধে দিতেনও সবসময়। তাঁর জাদু ছড়ানো রান্নার কথা আরেকদিন বলব।

বাড়ির পেছনে আবার একটা নিমগাছ , ছাদ থেকে হাত বাড়িয়ে মা পারত নিমপাতা, আর আমি সবজে-হলুদ পাকা নিমফল। নিমফল খেতাম আমি কাকেদের সাথে বসে। একবার তো শরতবাবুর কোন এক ছোটগল্পের থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিমের দাঁতন করার চেষ্টাও করেছিলাম। ব্যাপারগুলো বললে বোধহয় নামী ইংরেজি স্কুলে বন্ধু পাওয়া দুষ্কর হত আমার পক্ষে। অদ্ভুত ব্যাপার, বাড়িটাই যেন শিখিয়ে দিয়েছিল জল হয়ে থাকাটা। কোথায় কেমনভাবে কোন আকারে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে হবে।

তবে খাস ৯৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হয়েও কোনোদিন গ্রামবাংলার বুকের থেকে উঠে আসা কোন গল্পকে মন দিয়ে ছুঁতে অসুবিধে হয়নি। দুটো মাত্র ঘর , তবু আলমারি ঠাসা ছিল ঠাকুরমার ঝুলি থেকে রবীন্দ্র, শরৎ , বঙ্কিম, বিভূতি , শিবরামে। আর চারিদিক জুড়ে ছিল আমার নিজের ওয়াণ্ডারল্যান্ড । এমনি এমনি তো আর বান্ধবীদের স্ল্যামবুকে ফেভারিট বুকের জায়গায় জুলে ভার্ন, কনান ডয়াল এর পাশাপাশি পথের পাঁচালীর নাম জ্বলজ্বল করত না।

বাড়ির উত্তরদিকে ছিল একটা টিনের চালের পোড়োবাড়ি, সাপেদের স্বর্গরাজ্য ছিল জায়গাটা। খুব বেশি মনে নেই, কারণ বড় হওয়ার আগেই ওটা ভেঙে নতুন বাড়ি উঠেছিল। তবু যা মনে আছে, প্রথম ডুমুর গাছ, ফুল, ফল সব দেখেছিলাম ওখানেই। আর ছিল আমার খেয়ে ছুঁড়ে ফেলা বীজের থেকে গজানো একটা বাচ্চা পেঁপেগাছ, কিছু কলাগাছও ছিল বাড়িটার সামনের দিকে। আর ছিল বাড়ির দেওয়াল জুড়ে বট- অশ্বত্থের চারার মাঝেই সদর্পে তরতরিয়ে ওঠা তেলাকুচ আর মানিপ্ল্যাণ্টের ঝাড়। ও , আর একটা কাঞ্চনফুলের গাছ, লাফিয়ে যার পাতা পেড়ে পোঁ করে বাজাতাম আম- আঁটির ভেঁপুর আমার ভার্সন।

বাড়ির পেছনদিকে ছিল আরও একটা বাড়ি যাদের পেয়ারাগাছের অর্ধেক ছায়া পড়ত আমাদের দেওয়ালের এপারে। কাঁচা কষটে পেয়ারার স্বাদ ওখান থেকেই প্রথম পাওয়া।

পাশের বাড়ি থেকে ঝুঁকে পড়া একটা বেলগাছ আর ইউক্যালিপ্তাস ছিল। তাদের পাতা ওপেন ড্রেনটার মুখে লাগাম লাগাতে চাইত চিরকাল। তবে বেল পাকলে কাকের যে কিছু নয়, আর কোকিল যে কাকের বাসা খুঁজে খুঁজে ডিম পাড়ে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবই চাক্ষুশ করার সৌভাগ্য হয়েছিল ওই বেলগাছটার সৌজন্যে।

আরও অনেক গল্প আছে, গাছগুলোর সাথে আমার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার , বা নিমগাছটা কেটে ফেলায় আমার সারাদিনের অসম্ভব কান্না আর সেই প্রথম রাগ করে না খাওয়ার।

তবু এখনও নিজেকে ভাগ্যবান লাগে। বাকি দুনিয়া যখন সবে গপগপাচ্ছে বার্গার, পিৎজা বা হ্যারি পটার, সেই সময়েই আমি চিনেছিলাম থানকুনি পাতা, আম্রপালি , সুপুরিফুলের ইনফ্লোরসেন্সের সেই আচ্ছন্ন করা মায়ের খোলা চুলের মত সুগন্ধটা।

সৌভাগ্য ছিল এতদিন , যে আমার বর্তমান নিজেদের বাসাটিও বেশ একটা গ্রামমাটির গন্ধ নিয়ে ভরে ছিল। চারদিকে পরপর ছটা ফ্ল্যাট উঠে যাওয়ায় আজ হঠাৎ বড় মনকেমন লাগছে।

ও হ্যাঁ, সম্মানীয় পরিচালক মশায়রা, সাউথ কলকাতার এঁদো গলিও “নস্টালজিয়া”-র জন্ম দিতে পারে।


Leave a comment

#প্রথম_বোর্ড_এক্সাম

 
মাধ্যমিকটা ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা, এবং দুর্ঘটনাও বটে। বরাবর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা গোবেচারা ছাত্রী ছিলাম। “মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে” আর কি! কো -এডে পড়তাম, পড়ার থেকে মুখ তোলার ফাঁকটুকুতে ওই বয়সোচিত কিছু গাল রাঙানো মুহূর্তও ছিল ক্লাস সেভেন- এইট থেকে। তবে মাথার ওপর ঝুলিতেছে খাঁড়া, মাধ্যমিক। না জানি সে কত ভয়ঙ্কর এক দত্যি দানো , তবে সে আসার আগে অন্যকিছু করলে বা ভাবলেই নাকি সব শেষ। গান শিখতে কোনকালেই বিশেষ আগ্রহী ছিলাম না, তাই ক্লাস এইটের শেষে হারমোনিয়াম বাক্সবন্দী হয়ে যাওয়াতে বেশ মজা পেয়েছিলাম, তবে আঁকার তুলিগুলো রং শুকনোর আগেই কেড়ে নিয়েছিল মাধ্যমিক, আজও ক্ষমা করিনি …
তা এই কালান্তকারী মধ্যবিত্ত বাঙালী মেডুসাকে আপ্যায়ন করতে আয়োজন নেহাত কম করিনি, বাবার কাছে অঙ্ক, আর বাংলা বাদে বাকি সব টিউটর , দিনের শেষে বাড়ি ফিরে বিছানাটা মনে হত স্বর্গ , আর মায়ের মাথায় বোলানো হাতটা যেন মেডুসার অভিশাপের মাঝে স্বপ্নপরীর জাদুকাঠির ছোঁয়া।
 
ঢোঁক গিলে একশা হয়ে ,পকেটে ঠাকুরের ফুল আর একবুক অতিকষ্টে জড়ো করা বাহারি কনফিডেন্স নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম অচেনা একটা লাস্ট বেঞ্চের কোণে। উতরে গেল ভালোভাবেই সব, এখন চুপি চুপি বলি , অঙ্ক পরীক্ষায় কটা অবজেকটিভ উত্তর মিলিয়েছিলাম পাশের বান্ধবীর সাথে। যদিও কোন এক “দেবদূতে”র কৃপায় ১৫ দিন দু-স্বাগত বাড়তি ছুটি পেলাম, ফিজিকাল সায়েন্সের প্রশ্নপত্র লিক হয়ে যাওয়ায়।
পরীক্ষা শেষোলো। বহুদিন ডিউ থাকা ভেসে বেড়ানোর ছুটিটাও।
 
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ , ১৫ মিনিট বাদে রেজাল্ট, চোখ টিভিতে, মন আগের রাতের ভয়ানক দুঃস্বপ্নে। তা কদিন আগেই স্কুলের শংসাপত্র পেয়েছিলুম যার হাত থেকে, সেই সেদিনের প্রধান অতিথি পর্ষদ সভাপতি মহাশয়ের পাশের হার , মেধা তালিকার ফাঁকেই নেট জানাল ৮৯ % পেয়েছি। অঙ্কে ১০০। বাবার পরিশ্রম সার্থক, মা-র চোখ ছলোছলোর ফাঁকেই স্কুল থেকে প্রিন্সিপালের ফোন , স্কুলে থার্ড নাকি আমি, জরুরি তলব।
তারপর একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল, কোন একটা নিউজ চ্যানেল পাকড়াও করে নিয়ে গেল, কিসব জিজ্ঞেস করল, সারাজীবন স্টেজে উঠলে যার গলা কেঁপে ঘেমেনেয়ে একশা কাণ্ড হয় সে যে কি বলেছিলাম আজও মনে নেই। তবে ওরা বার্গার আর কোক খাইয়েছিল মনে আছে।
 
এখন যখন কলেজের এক একটা পরীক্ষায় পাশ মার্ক তুলতে হিমশিম খেতে হয়, মাধ্যমিকের দিনগুলো এখনও মেডুসার মতই পরিহাস করে। সেই জ্বালাটা আমিই বুঝি, বাবা মা-র আশাহত চোখ গুলো দেখলে এখন, আত্মীয়দের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি, “মেয়েটা পুরো বেকার হয়ে গেল” এই শোনার ভয়ে। ভুলেও মনে আনি না সেই দিন গুলো। ভুলেও না। ভাই বোনেদের পরীক্ষার আগের দিনগুলো তে তাই ফোন তুলে ভালো করে দিস বলি না; বলি, যা হয় হবে ভাবিস , এটা একটা পরীক্ষা শুধু যেটা ঘিরে অপ্রয়োজনীয় হাইপ, জীবনটা আরও অনেক বড়।


Leave a comment

রায়বাবু – পর্ব ১

রায়বাবুকে নিয়ে সকলেই লিখছেন, আমিও লিখি। 😀

রায়বাবু – পর্ব ১

ছোটবেলায় কেবল লাইন , কালার টিভি ছিল না। রবিবার বিকেল ৪ টের সময়ে ডিডি বাংলায় “সা সা নি ধা পা ধা নি”-র সুরে একটা করে সিনেমা হত, বেশিরভাগই পসেনজিত- অঞ্জন চৌধুরী- তাপস-মুনমুন। তবে ছোট থেকে বাবার কল্যাণে মোটামুটি এটা বদ্ধমূল হয়ে গেছিল যে সিনেমা = সত্যজিত তাহার উপরে নাই। তাই ২-৩ মে সহ বছরের যেই কদিন গুগাবাব বা সোনার কেল্লা বা কালেভদ্রে পথের পাঁচালি / অপুর সংসার দেখান হত, সেই দিনগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। সেসব রবিবার সকালে কাগজে আজকের সিনেমার কলাম দেখে আগে আগেই স্নান-খাওয়া-ঘুম সেরে রেডি। পরদিন হোম টাস্ক? টেস্ট? ওই কঘণ্টা থোড়াই কেয়ার।
আমাদের বাড়িওয়ালা দের ঘরে কেবল লাইন ছিল। ওই কেবলের একটা নিজস্ব চ্যানেল হত না? যেখানে সকালে স্বামী কেন আসামী আর রাতে শোলে আর গভীর রাতে অকহতব্য ভোজপুরী বিকৃতরুচির সিনেমা দিত? সেই চ্যানেলে গুগাবাবা বা হীরক রাজা হলেই জেঠু হাঁক পারতেন। গোগ্রাসে গিলতাম সেসব, সবিস্ময়ে।

স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে ফিসফিস হত যখন শাহরুখের দেবদাস নিয়ে, বুঝতামই না কি বলছে। আফসোস ও ছিল না তেমন, একটাই, যে অপু বা উদয়ন পণ্ডিত বা মগনলাল বা আচার্যদেব কে নিয়ে কথা বলার লোক পেতুম না বিশেষ।

একবার আমার থেকে খানিক বড় এক মাসি বেড়াতে এসেছে। তদ্দিনে সবে কেবল এসেছে। সেদিন দুপুরে পথের পাঁচালি, আমি তো স্নান করে খেয়ে দেয়ে নাচতে নাচতে টিভি চালাতে এসছি, ওমা, মাসিমনি দেখি স্টার প্লাসে বুঁদ। তার নায়িকার আজকে দ্বিতীয়বার বিয়ে, সিঁদুর পড়ানোর আগের মুহূর্তে নাকি প্রাক্তনের (মৃত ?) প্রবেশ ঘটবে।
সে এক মহাযুদ্ধ রিমোট নিয়ে। অবশেষে মায়ের হস্তক্ষেপে মাসিমনি রাজি হল রিপিট দেখে নেবে বলে। তাই অপুর পাঠশালে যাওয়া থেকে দেখতে পেলুম সেবার।
হরিহর যখন ” এই দ্যাখো না দুগগা মায়ের জন্য এই শাড়িখানা এনেছি” বলে শাড়িটা মেলে ধরল, ওমা, মাসি দেখি ঝরঝর করে কাঁদছে।

শুনলুম বাড়ি গিয়ে মাসি পরপর সব সত্যজিৎ দেখে ফেলেছে কদিনে।

ক্লাস এইটে যখন ভাড়াবাড়ি ছেড়ে এই বাড়িতে আসলুম, মনে হল পুরো সবটাই ওখানে ফেলে এলুম। এত বড় বাড়ি, চারিদিকে খোলামেলা জায়গা, চড়ুই আসে সকালে আর ঘুঘু বাসা করে ডিম পেরেছে চিলেকোঠায়, মন তখনও সিদ্ধান্তে অনড় যে জায়গাটা খুব বাজে।

পাশের ঝা চকচকে পাড়ার ঠিক মধ্যিখানে একচিলতে বেমানান বাশবাগান । কৌতূহল হল।
খোঁজ নিয়ে শুনলাম এই অঞ্চল আগে পুরোই বাঁশের ঝাড় ছিল, আর ঠিক ওই মধ্যিখানের জায়গাটুকুতে গুপী বাঘা তিন বর পেয়েছিল।

আরও শুনলাম, আমার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে বোড়াল নিশ্চিন্দিপুর।

আর আমাকে পায় কে?

পুনশ্চ ঃ মহানুভব প্রোমোটারের দাক্ষিন্যে ওই একচিলতে জায়গাটুকুতে আজ সুদৃশ্য বহুতল। আমি সেই এপার্টমেন্টে পড়াতেও যাই।


Leave a comment

আমি বাংলায় জ্ঞান গাই

আমরা যারা ফেসবুক আর নিজেদের বিনি পয়সার ব্লগের বাইরে হালে পানি না পাওয়া “লেখক” , তাদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। ১৪ই হোক বা ২১ , ফেব্রুয়ারিতে কিছু না কিছু আগডুম বাগডুম বিদ্রোহী কচকচানি পোষ্টাতে হবেই।  প্রেম দিবসের অযৌক্তিকতা হোক বা ভাষা দিবসে “বং”সমাজের ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখানো , ফেবু দেওয়াল লিখনে লাইকের সংখ্যাটা ৩০ ছাড়ালেই বেশ একটা “মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে…” গোছের আচিভমেন্ট মনে হয়। তাপ্পর যখন পরিচিত কারোর লেখায় ২০০-২৫০ লাইক দেখা যায়, তখন কাল্পনিক পেন্নাম ঠুকে “গুরুদেব” কমেন্ট করাটা অনিবার্য।

সকালের কাঁচা ঘুমটা যখন পাড়ার ক্লাবের “মোদের গরব মোদের আশা’’ দ্বারা ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হল, মনে মনে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় বাছা বাছা কিছু শব্দ প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে ভাষা দিবসের শুভ সূচনা ঘটল।

একবার এক বন্ধুবর বলেছিলেন, বাঙালি আদর করে বাংলায়, কিন্তু ঝাড়ে ইংরেজিতে। কথাখানা খাঁটি। তবে মাইরি বলছি, আমার বিশ্বাস সেটা স্থান-কাল-পাত্র সাপেক্ষ। ধরুন নব্য প্রেমিকার সামনে ফোন এলো কোন “বাতাসল্যাজ” কোম্পানির নেকাপিনার। তখন ইংরেজি আবশ্যক।  কিন্তু সেই প্রেমিকাকেই বিয়ে করলেন, সুখে থাকলেন ; তখন কিন্তু জিরেগুড়োটা নেই কেন সেই বচসায় শালিমার নারকোল তেলের মত বাংলাই বেরোবে। বা ধরুন ফ্লিপকার্ট আপনাকে জালি ডেলিভারি দিয়েছে। তখন তো শেক্সপীয়ারকে কবর থেকে জাগিয়ে তোলার যজ্ঞের আয়োজন করা অবশ্যম্ভাবী। অথচ “ডাক্তারবাবু কদিন ধরে লুজ মোশান কমছে না ’’-র পরবর্তী আলোচনাটা কিন্ত আপনার সুরুচিসীমা পেরিয়ে অ্যাঁ মরি বাংলা ভাষাতেই হবে। সে আপনি যতই লাল-নীল-হলুদ-(সবুজ) হয়ে যান না কেন লজ্জায়। বেরিয়ে ঝটিতি ইন্টারনেট ঘেঁটে আপনার বাংলা রোগের জার্মান/ জাপানি/ লাতিন পরিভাষা মগজস্থ করে নেবেন, পরদিন সহকর্মীদের শোনাতে তো হবে?

আজকে অনেক “আমার মেয়ে বাংলাটা ঠিক পারে না” বাবলির মা, “ইশ…রবীন্দ্রসঙ্গীত! ” ন্যাকাপিনা, “হ্যাপি ভাষা দিবস টু অল অফ ইউ” ডারপেন্দ্র দের ওপর অনেক ধিক্কার করেছেন সারাদিন ধরে।

আমারও লাগে, খারাপ লাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু এটা ভয় পাবেন না, বাংলা ভাষা মরবে না কোনদিন। আচ্ছা আমাদের মায়েরাও তো তাদের শখ অনুযায়ী সাজগোজ করেন, তা বলে কি ঘুমোতে যাওয়ার আগের আঁচলের মা-মা গন্ধটার তারতম্য হয় কোনদিন?

বিয়েবাড়িতে হয়তো আপনার শিফন শাড়ি আর হল্টারনেক ব্লাউজ অনেক “র‍্যাভিশিং” “সেক্সি” “হট”-এর ছয়লাপ করে দিল। তা বলে কি অষ্টমীর ঢাকাই জামদানিতে মায়ের “তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, কত বড় হয়ে গেলি”-র মাহাত্ম্য কম হয়?

পিজার ওপরের এক্সট্রা চিজ আয়েশ করে “ইয়াম্মিইই…” বলে খাওয়াটা নিঃসন্দেহে স্বর্গীয় , তা  বলে কি শীতের প্রথম নলেন গুড়ের রসগোল্লা মুখে পুরে  অস্পষ্ট “আহা” –র সাথে তার কোন তুলনা হয়?

ব্রেকআপের পরপর পিঙ্ক ফ্লয়েড । হিলিং। জানি। কিন্তু অনেকদিনের পরের আলগা বর্ষার রাতে হঠাৎ ছেয়ে আসা মনকেমনের “ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে…” ; আপনিই বলুন?

“I love you যত সহজে বলা যায়-
“আমি তোমাকে ভালোবাসি” ততো সহজে বলা যায় না।” আমার নয়, হুমায়ুন আহমেদের কথা।

হিচকক। নোলান। স্করসেসি। ঘোর কাটতে সময় লাগে এক এক ক্ষেত্রে। কিন্তু হরিহরের ফিরে আসার পর সর্বজয়ার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েননি, এমন বাঙালি খুঁজে বের করুন তো?

তাই হে বঙ্গবাসী। শঙ্কিত হইবেন না অযথা। আমাদের মা ছিলেন। আছেন। থাকবেন। বেশভূষা বদলান একটু মাঝে মাঝে নাহয়।

ভেবে দেখুন না, আমি খাই ইলিশ পাতুরি, দেশের বাড়িতে গেলে বলি “আইলাম, যাইলাম , অহন, ক্যাডা, পোলা ।’’ লাল-হলুদ ।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু খান পোস্ত । বলেন “ নোব, দোব, এতগুনো , হাঁসপাতাল।’’ সবুজ-মেরুন।

এদের মধ্যে কে বাঙালি নয় ? বলুন দেখি!

আমি লিখি “আছি, করছি, পড়ছি।’’ ময়নার মা বলে “ বুদি, টমাটমের চাটনি কইরেছ আজ? ’’ পশুপতিকাকুর রিক্সায় চাপলে একগাল হেসে বলে, “কুথায় যাবে গো মা? কাল আসো লাই কিনো ? ছুটি ছিল বটে? ’’ পড়াতে গেলে স্টুডেন্টের বাড়ির রান্নামাসি গল্প জোড়েন , “ আমাদের উখানে  মেইদের ১৮-১৯এ বিয়া হই যায়। ইসব চাকরি টাকরি করে না কেউ।’’

বাঙালি বলে অস্বীকার করব কাকে?

তবে সেইভাবে ভেবে দেখলে বাংরেজি কেও অমান্য করতে পারি না আমি।

জনৈক বাংলাদেশীয় বন্ধু বলেছিল ওপার বাংলার, ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘরের সমারোহ, আজকের দিনটায়। কবে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে জানিনা।

ততদিন বেঁচে থাক আমার রাঢ়ী , বঙ্গালী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খণ্ডি , কামরূপী। বেঁচে থাক আমার বাংরেজি। বেঁচে থাক আমার বাংলার মাটি, বাংলার জল। বেঁচে থাক বিশ্ববাংলা। বেঁচে থাক আমার ব এ ওকার , চ এ ওকার। বেঁচে থাক একুশে ফেব্রুয়ারির ছুতোয়  আইবি-র বদলে খাঁটি “বাংলা”র আসর। বেঁচে থাক বাঙালি, বেঁচে থাক বাংলা।

 

পুনশ্চ ঃ অধমের সীমিত জ্ঞান নিয়ে বাংলা ব্যাকরণ ,ইতিহাস, পরিভাষা নিয়ে বাগবিতণ্ডা করবার ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন গুনীজনেরা।


Leave a comment

স্বার্থ

এটা সেই দেশের সেই বৃহদাংশ ভুক্ত মেয়েটার কাহিনী , যে “আঙুর ফল টক” গোছের প্রেম দিবসের বিরোধিতা করে… আবার সুখের সময়ে ঘটা করে “ভ্যালেন্টাইন সেলফি” সাঁটায় ভার্চুয়াল দেওয়ালে। নিজের একটার পর একটা এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অসফল হওয়ার ফাঁকে যার মাথায় জেএনইউ বা ভেমুলা বা চা বাগানের কথা থাকে না। যার কলেজে “পলিটিক্স” নেই বলে গোপন গর্ববোধে লজ্জিত বোধ করে তার বন্ধুদের প্রতিবাদী সত্ত্বার দৃঢ়তার কাছে। যার ঝুলিতে ট্রামে বাসে ট্রেনে অনেক “সম্মানরক্ষার” যুদ্ধজয়ের গল্প থাকলেও , যার বাড়িতে নিত্যদিন বেঁচে থাকার অকথ্য লড়াই সত্ত্বেও তারা আদপে ভীতু… রাষ্ট্র , রাজনীতি, ধর্মীয় নিরপেক্ষতা শব্দগুলো উচ্চারণ করতে। এই তো বেঁচেবর্তে আছি চুপচাপ, কি দরকার পাশের পাঁচ জনের জীবনে নেগেটিভ প্রভাব ফেলার?
মেয়েটা প্রতিবাদ জানায় না কিছুর। বোঝেই না কার পক্ষ নিয়ে , কার বিরুদ্ধ হয়ে কথা বলবে। কোনভাবে কথা বললে শ্যামও থাকবে কুলও থাকবে, মানে কিনা এই সংস্কারযজ্ঞের কাণ্ডারিরা আর ফেসবুক- ইন্টারনেট ছেয়ে ফেলা ‪#‎standwith‬হাশট্যাগে সীমাবদ্ধ প্রতিবাদীরা , কোন পক্ষই গায়ে লাগাবে না। বুঝে উঠতে না পেরে সে চুপ থাকে, তাতেও শিরদাঁড়াহীন বলে চিহ্নিত হয়।
তবু এক একদিন রাত্রে এই মেয়েটিরই মনে হয় এই র্যাতডিকাল টাইম বোম্বে পরিণত হওয়া তার দেশটায় , তার ভবিতব্য কি হত, যদি সেই ছেলেটা এখনও তার জীবনে থাকত? খুব তো শখ করে একদিন ধর্ম জাত পাত মানি না বলে বড় গলা করে দুজনে জুড়েছিল। পারল টেকাতে? সেই তো কয়েক মাসের বাড়ি থেকে পালানোর ধোঁয়াশা প্ল্যান বা নিজের অসুস্থ মায়ের সাথে দাঁতে দাঁত চেপে অসহ খারাপ ব্যবহারের নাটক , কত রিহার্সাল, কত ব্লুপ্রিন্ট… টিকলো কিছু? একদিন তো শুনতেই হল “ আব্বা আম্মু কিছুতেই মানছে না। ” তবু মেয়েটার সেইদিন টার কথা মনে পড়ে। মহরম ছিল। ছেলেটা খুব মুষড়ে ছিল, বলছিল শুধু , “ আমাদের এই দেশটা ছেড়ে চলে যেতে হবে রে, থাকতে পারব না এখানে এরকম জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।’’ তখনও তো মোড়ে মোড়ে পালস পোলিওর মতন গেরুয়াকরন অভিযান শুরু হয়নি। বাচ্চা মেয়েটা ভেবেছিল নিজের বাড়িতে ডেকে নেবে ওকে, ওর পরিবারকে, ওর সমাজকে।
সব নিয়মকে তুচ্ছ করে যখন পারল না, তখন একবার শেষ চেষ্টা করল উল্টোপথে। ছেলেটার হাতে উঠেছিল গীতা, আর মেয়ে টার হাতে অনুদিত কোরান। হল না, জানেন? না হওয়ারই কথা। যুগান্তরের হাওয়ায় রচিত ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না।
স্বচ্ছ ভারতের আড়ালে যখন সংখ্যালঘু অভিযানের ছক কষা হচ্ছে জয় শ্রীরাম ধ্বজাবৃত তলোয়ার-কাটারির গোপন গুদামে, তখন ভারত পাকিস্তান ম্যাচের দিন ভারতের জন্য দুজনেই সোচ্চারে গলা ফাটিয়েছিল। ম্যাচ শেষে আফ্রিদির হতাশ বিবৃতি একইভাবে মনখারাপ করেছিল দুজনের।
অনলাইন গেম খেলার সময়ে কোনো পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ থাকলে মেয়েটা খেলার শুরুতে বা শেষ সামান্য অভিবাদন জানাতে ভোলে না, অধিকাংশ দিনই courtesy টা ফেরানো হয় কিন্তু!
এটা শুনে মারতে আসবেন? মেয়েটা পাকিস্তান-সমর্থক বলবেন? বলুন। তবে এটুকু জেনে রাখবেন হিন্দুধর্মটা আপনাদের মত নিরক্ষর নিদেনপক্ষে ক্লাস ফোরের জ্ঞান পরিসীমার থেকে অনেক অনেক বড় আর নিরপেক্ষ ।
মেয়েটা তাই গর্বের সাথে বলে আমি হিন্দু। এবার মেয়েটা ভালো হয়ে গেল তো?
দাঁড়ান।
মেয়েটা সত্যি হিন্দু বলেই সে দলিত, মুসলমান , বেশ্যা সবার সাথে খাবারের থালা ভাগ করে নিতে পারে, জলের গ্লাস শেয়ার করতে পারে। একটা বিধর্মী মানুষকে বিনা দ্বিধায় ভালবাসতে পারে।

প্রথমেই বলেছিলাম , প্রতিবাদ মেয়েটা বোঝেনা। স্বার্থপর । ভীতু। কারণ সে বুঝছে বর্তমানের প্রেক্ষিতে কি ভয়ানক পাপ সে করেছে। তাই সে চুপ, কেঁচোর মত শিরদাঁড়াহীন। প্রাণের ভয়টা তারও আছে কিনা।


Leave a comment

বইমেলা ২০১৬

এক হপ্তা হয়ে গেল ২০১৬ বইমেলার, ভার্চুয়াল কিচিরমিচিরের দৌলতে যাদের জন্য এটি সেলফিমেলা বলে প্রবর্তিত হচ্ছে, তাদের কিছুই যায় আসে বলে মনে হয়না। আমরা যারা সত্যি সত্যি বই কিনলুম বলে ইকো- ফ্রেন্ডলি প্যাকেট উচিয়ে, বাসে অযাচিত লাথি- গুঁতো সহ্য করে বাড়ি ফিরি,   সমালোচনামূলক ফেবু “স্ট্যাটাসের” খসড়া মাথায় নিয়ে , তাদের অবস্থাটিও শোচনীয়। অন্তত আমার মত চিরকালীন হীনমন্যতায় ভোগা পাবলিকরা তো বটেই। পেটুক বড্ড, তবু কাল্পনিক “মান”  বাঁচানোর স্বার্থে ফুডকোর্টে বেশি সময় ব্যয় করা যাবেনা। বহুদিন সঙ্গীটির সাথে ছবি তোলা হয়নি, আবার কবে দেখাসাক্ষাৎ হবে জানা নেই, তবু তোলা হয়না, এই রে কেউ যদি দেখে ফেলে আমাদের নিয়ে পোস্ট দেয়? ঘনিষ্ঠ মহলে অনন্ত ল্যাদখোর সম্মানে ভূষিত আমার অবশ্য স্ট্যাটাস দেওয়ার বিশেষ মনোবাসনা ছিল না।তবু জনৈক অত্যুতসাহী এক ব্যক্তি -_- প্রকাশ্যে আমাকে রেকমেনড করায় এখন পশ্চাৎ রক্ষার্থে এবং উপরোক্ত কৃচ্ছসাধনের পরিপুরক হিসেবে এই পোস্ট দিতে উদ্যত হলাম।

গৌরচন্দ্রিকা অনেক হল, রচনা আরম্ভ।

 

আমার ২০১৬ বইমেলা গমন।

 

ক্লাস থ্রি থেকে শেখানো হয়েছে, যাহা ঘটিয়াছে তাহার ওপর ৩-৪ কোট রং না চড়াইলে রচনাতে ভালো নম্বর পাওয়া যায় না। বেদবাক্য উপেক্ষা করেই পরীক্ষায় বইমেলা কেমন লাগলো তে লিখেছিলুম বই কেনা, খাওয়া দাওয়া, ধুলোস্নান করা (ময়দানে হত তখন) প্রভৃতি । মন্দ পাইনি সেবার। এখন নম্বর পাওয়ার সিন নেই, লাইকের লোভ আছে যদিও, তবুও আরেকবার সত্যচারণ করতে মন চাইছে।

কানে ফুল ভলিউমে লিন্‌কিন পার্ক চলছিল, মেলার কাছাকাছি আসতেই আবার সেই ভয়ে খুলে রাখলুম। ঢুকেই পেটে ২ প্যাকেট জল ও মাথায় অবধারিত সানগার্ড লাগিয়ে  তেনার লেজুড় ধরে প্ল্যান ভাঁজছিলুম, কি করব, কি কিনব, কি খাব ভেবে। গুটিকয়েক পালস পরপর মুখে পোরার ফাঁকে পরিচিত জনদের বইগুলো টপাটপ ব্যাগবন্দী করলুম। জানি যে বিদেশি ভাষার বইগুলো ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজন থেকেই আসবে, তবুও আর ৫টা বাঙালি বোদ্ধার মতো পেঙ্গুইন, অক্সফোর্ড , ক্রসওয়ার্ডের দোকানে ঢুকে  পড়ে ফেলা বইগুলোর ওপর ৪-৫ লাইন বৈমাত্রেয় ভাষায়  জ্ঞানবিচ্ছুরণ করতে লাগলুম পাশের কাঁচাপাকা বয়কাট কুর্তি – জিন্‌স বা সুদর্শন কেতাদুরস্ত ঝরঝরে ইংরিজি ছোকরাকে উদ্দেশ্য করে। বাঁধ সাধলেন সঙ্গীমহাশয়। আমার মতনই কয়েকজনকে দেখে তার দুষ্টুবুদ্ধির উদ্রেক হল। একটি- দুটি সলমান রুশদি বা পামুক বা নাইপল হাতে নিয়ে গোবেচারা মুখ করে “এইগুলা কি লেখা গো? বুজি না তো! ছবিটা ভালো লাগলো তাই দেকলাম। এত্তু বুজিয়ে দেবে? ” শুরু করলেন। পাশের শর্ট ড্রেস – লাল লিপস্টিক- হাতে আয়ান র‍্যানড / পাওলো কোয়েলহো -র  বিস্ফারিত “ডিসগাস্টেড ”  নজরের সামনে তখন কলাগাছ  শুকিয়ে আঙুল। অবশেষে জীবনে প্রথমবার মহাশয়ের পদাঙ্ক অনুসরন করলাম। বিশ্বাস করুন, ছেলেবেলার ভরদুপুরের আচার চুরি করার মত অদ্ভুত একটা আনন্দ হল।

 

তারপর আরও অনেক কিছু ঘটেছে , রটেছে , ফেটেছে।

 

চিংড়ির পাকোড়ার নামে বিস্বাদ আটার দলা  গলাধঃকরন করে দুজনে যখন হাসছি, চোখে পড়ল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টল। তার সামনে দাঁড়িয়ে সেন্সর-বিরুদ্ধ কাজ করবার মতলব করছি , দেখলুম এক হিজাব- বোরখা পরিহিত ভদ্রমহিলা তার মেয়েকে নিয়ে স্টলের সামনে গিয়ে বসলেন নির্বিকারভাবে। ঢিপঢিপ বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কেটে গেল অনেকক্ষণ। স্টলকর্তারাও নির্বিকার।

বইমেলা। 🙂

 

প্যাভিলিয়নে ঢুকে ডাকফেস সেলফিতে ফটোবম্ব বা বলিভিয়ার রাজধানী ভুলে যাওয়ার মত “ইরেলেভান্ট ডিটেল ” দিয়ে আর বোর করব না। তবে অনেকদিন পর মনে হল চোখটা একটু বড়ভাবে খুলল । ক্রেডিটটা নবকলেবর নব্যবাঙালির শেষ শীতের চিরন্তনী কার্নিভাল বইমেলার প্রাপ্য। ভালো লাগলো অনেকদিন পর। আমার কথাটি ফুরল। ইতি টানলুম রচনায়।

দেখি কত নম্বর পাই।

 

পুনশ্চঃ খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু নানা কারনে সম্ভবপর হল না, এই বইমেলায় আমাদের নতুন বই ” বৃষ্টিভেজা রুপকথারা” প্রকাশিত হওয়ার। তবে সদ্য আসতে চলেছে, গতানুতিক ভালোবাসার গল্পের বাইরে বেরিয়ে এক ফেব্রুয়ারি স্পেশাল সংকলন ,  কিছু ডানা মেলা অচেনা পাখি। পড়ে দেখুন বা উপহার দিন, ভালো লাগবে । 🙂


Leave a comment

পুজোনামচা

পুজোনামচা – ১

ষষ্ঠী

লেবু চা, পুতুল নাচ আর স্ট্রিটলাইটের মা

বেরিয়েছিলুম আজ, ষষ্ঠী, থুড়ি মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায়। কি যেন বলি আমরা? প্যান্ডেল হপিং। দেশপ্রিয় পার্ক না হয় বন্ধ, তার জন্য সেই শুক্রবার সাড়ে ছটার কাটোয়া লোকালের ভিড় টা নেই; তবে কিছু কমতি নেই মানুষের উৎসাহে। ঝলমলে নয়নাভিরাম আলোকসজ্জা, রীতিমত গভীর self-analysis এ নিমগ্ন  করে দেওয়ার মতো থিম, নামকরা শিল্পীদের নজরকাড়া শিল্পনৈপুন্যে ঋদ্ধ এক একটা পুজো । কেউ কারোর চেয়ে কম যাওয়ার পক্ষপাতী নয়। প্রতিবছর একই চেনা জায়গাগুলোর আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে  ওঠাটা সবসময়ই কেমন একটা আশ্চর্য লাগে। যেহেতু কিছুদিন আগেই কয়েকজন বাচ্চার মুখে পুজো- নামাঙ্কিত হাসিটা ফোটানোর একটা ছোট প্রচেষ্টা নিয়েছিলুম, নিয়মমাফিক আমার উচিত ছিল পুজোতে আনন্দে যাকে বলে উদ্বেলিত না হয়ে ওঠা। যে ছেলেটার থেকে ধুপকাঠি কিনলুম সহানুভূতি দেখিয়ে, বা যেই ভিখারি বাচ্চাটাকে আমার চকোলেট টার অর্ধেক ভাগ দিলুম, বা যেই মেয়েটা আমার আইসক্রিমের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে ছিল…হয়তো উচিত ছিল আরও একটু মুখ বেজার করার, আরও দু-এক ফোঁটা আড়ালি চোখের জল ফেলার। হল না, জানেন তো! কিছুতেই পারলাম না নিজের উচ্ছলতাকে দমন করতে, বুঝলুম বড় হওয়া বাকি রয়ে গেছে। বরং কেমন একটা আনন্দ হল, রঙচঙে সবুজ জামাটা পরে যে ক্লাস ৫ বাবার সাথে প্রথম কলকাতার পুজো দেখার বিস্ময়কে লুকোনোর কাঁচা অভিনয় করে বড় হয়ে গেছি ভাব নিয়ে , “এদিকে আসুন, লেবু চা, লেবু চা” করে হাঁক পাড়ছিল, তাকে দেখে; তার সন্তর্পণে এগিয়ে দেওয়া প্লাস্টিকের  চায়ের কাপে ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে বেরনো রামধনু আলোয় উজ্জ্বল দুটো চোখ দেখে।

হিন্দুস্থান পার্ক সার্বজনীন এর প্যান্ডেল টা কটা পুরষ্কার পেয়েছে জানিনে, তবে স্বাদটা এখনও লেগে আছে মায়ের হাতের ভোগের পায়েসের মত। মেলা দেখেছি ছোট থেকে অনেক, তবে ওই টয়ট্রেন , ব্রেকডান্স, প্লাস্টিকের নিত্যনতুন খেলনার সম্ভারে আক্রান্ত আমার মেলা- স্মৃতি। মা-র কাছে শুনতুম , মায়ের ছোটবেলার মেলার পুতুল নাচে রামায়ণ, রথের মেলার তালপাতার পাখা, চার আনার নির্ভেজাল উচ্ছ্বাস, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, আশ্চর্য জাদুকরের ভেলকি, লক্ষ্মীসরার গল্প। সব দেখলুম ওখানে! নিজের ইমাজিনেশনের এরকম জলজ্যান্ত প্রজেকশন জীবনে খুব কম উপভোগ করে বিস্মিত হয়েছি।

পুজোর সাজে মেকওভার পাওয়া কল্লোলিনীর চেনা গলিকেও অচেনা ভেবে হারিয়ে যাওয়ার বাতিকটা এখনও বহাল আমার। সেখানেই পুজো- পুজো লাইট- সাউন্ড আবহের বাইরের এক স্ট্রিটলাইট চোখে পড়ল। হলুদ আলোর নীচে ছেঁড়া শাড়ির মাতৃরূপেন সংস্থিতা। আর এক নতুন লাল জামার ছোট মেয়ে।  হয়তো বড় পুজোর জৌলুস গায়ে মাখার অলিখিত পাসপোর্টের লিস্টে ওরা ব্রাত্য। “মা এবার খাব?”

“না এখন খুলিস না এটা।“

“মা খাই না, দাও না খেতে…”

“আচ্ছা আচ্ছা যা…” কথা শেষ হওয়ার আগেই ছিঁড়ে ফেলা একটা দশ টাকার চিপসের প্যাকেট। আর উন্মুক্ত অনেকটা আনন্দ…আনকোরা, নিখাদ, উচ্ছল।

পুজো এসে গেছে যে।।


Leave a comment

কাঠবেড়ালি

অদ্য শ্রীমান শতদ্রু মহাশয়ের চাউমিন প্রস্তুতিতে হাতেখড়ি ঘটিল।

 

এবং সেই অদ্ভুত কিছু সবজি সহযোগে বেশ উপাদেয় খাদ্যবস্তুটির পৃথিবীর আলো দেখা সার্থক করলাম আমি এবং এক অপ্রত্যাশিত অতিথিদ্বয় । এক কাঠবেড়ালি দম্পতি।

 

গাছের গুঁড়ি তে ঠেস দিয়ে বসে সারাদিনের অভুক্ত প্রত্যাশা-র সঙ্গে পরম উৎসাহে পাচকের জিজ্ঞাসু উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি আড়চোখে উপেক্ষা করে এক দুই তিন করে চামচ মুখে পুরছি ; আর পাচক মহাশয়ের আমার থেকে প্রশংসা পাওয়ার আশা ক্ষীণতর হওয়াতে যখন তিনি নির্লিপ্ত ভান করে এদিক ওদিক দীর্ঘশ্বাস ছড়াতে ব্যস্ত, হঠাৎ তার দৃষ্টিগোচর হল এক নিরীহ কাঠবেড়ালি অত্যন্ত প্রত্যাশী ভঙ্গি তে আমার চাউমিন খাওয়া দেখছে। তার নির্দেশে এক চামচ অতি সন্তর্পণে মাটিতে নিক্ষেপ করা হল। কাঠবেড়ালি মশাই ইতিউতি চেয়ে এক লাফে নেমে এলেন গাছ থেকে। আর একটু গা চুলকে ল্যাজ নাড়িয়ে গোঁফে চাড়া দিয়ে শুরু হল তার ভোজনপর্ব। আমরা দুজন খাওয়া থামিয়ে দেখলুম বেশ সেটা । খুঁটে খুঁটে অতি দ্রুত চাউমিন এর টুকরো গুলো খেয়ে তিনি দু হাত দিয়ে ধরে ডিমের টুকরো টা বেশ একটু কায়দা করে খেলেন। আমি উদ্বেলিত হয়ে তাকে আরও খানিকটা খেতে দেওয়াতে দেখলুম তিনি আর পালাচ্ছেন না, বেশ বীরদর্পে রাজকীয় ভঙ্গিমায় খাচ্ছেন পরম সুখে। শতদ্রু বাবু কে দেখলুম বেশ খুশিখুশি , আমি না হলেও কাঠবেড়ালিটি তার পরিশ্রমের মর্যাদা দিল বলে কথা । তার অতি উৎসাহে কাঠবেড়ালি কে গাজরের টুকরো দেওয়া হলে সে সসম্মানে তা প্রত্যাখান করল। এবং হঠাৎ ই প্রস্থান করল। আমরা খানিক আশাহত হলেও বেশ লেবু চা নিয়ে গুছিয়ে বসেছি;

ওম্মা!!! কী কাণ্ড!! কাঠবেড়ালি তার অন্তঃসওা অর্ধাঙ্গিনী কে নিয়ে হাজির। কাঠবেড়ালির ইচ্ছে ছিল বোধহয় একসাথে বেশ জমিয়ে লাঞ্চ সারবেন; কিন্তু সম্ভবত দাম্পত্য কলহের দরুন ( শতদ্রু-র থিওরি) কাঠবেড়ালিনী তাকে এক ধমকে তাড়িয়ে দিলেন, এবং তারপর একইভাবে তার ভুরিভোজ সারতে লাগলেন। শতদ্রুর সমগ্র পুরুষ প্রজাতি দের সংসারে এক ই দশা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মাঝেই তার খাওয়া কমপ্লিট করে এক ফেলে দেওয়া চা এর ভাঁড় থেকে কয়েক ফোঁটা চা খেয়ে আবার দূরে করুণ চোখে অপেক্ষা করা বর মহাশয় কে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন গাছের ডালে।

 

পুনশ্চঃ ভাবছি আজকের এই অভিজ্ঞতা টা শিক্ষামূলক ক্যাটাগরি তে রাখব কিনা