এখন যতই আমার শহর, ভেজা কাঁচের ওপারের হ্যালোজেন, নস্টালজিয়া নিয়ে রোম্যান্টিসিজম করি না কেন; আমার ছোটবেলাটা কিন্তু শহুরে হতে হতেও হয়নি… আর তার জন্য এখন খুব নিশ্চিন্ত লাগে।
আমরা থাকতাম সাউথের এক কলোনি এলাকার একটা ভাড়াবাড়িতে। বাড়িটার বাইরের রংটা ছিল অদ্ভুত একটা শ্যাওলাটে গোলাপী, একতলার যে দুটো ঘর জুড়ে থাকতাম সেখানে ছিল হালকা সবুজ। একটা ঘরের দেওয়াল জুড়ে ছিল অ্যাবস্ট্রাক্ট মিউরাল। না ভাই, ওটি কচি আমির শিল্পকর্ম । ক্রেয়নের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আঁকার স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে অবধি চলেছিল সেটা। তালগাছ থেকে গুপী-বাঘা, মা বাবা থেকে প্রথম দেখা পুরীর সমুদ্র কেউ বাদ যায়নি।
বাড়িটার সামনে পেছনে জুড়ে অনেকটা জায়গা ছিল। অযত্নলালিত একটা বাগান আর অচেনা গাছপালায় ভর্তি। দেশের বাড়িতে অনেক বড় জায়গা, বিশাল আম-জাম- কাঁঠালের বাগান থাকা সত্ত্বেও কেন জানি ওই শহুরে নামের আড়ালে ফিক করে মুচকি হাসা বাগানটা অনেক বেশি আপন ছিল।
যদ্দুর মনে পড়ছে, সামনের ক্যাঁচ করে আওয়াজ করা বড় লোহার গেটটার সদর দরজা বরাবর রাস্তাটা ছিল বাগানের বুক চিরে । আর ওই রাস্তার দুপাশে ঠাকুরপুজোর সাদা ফুল, অসম্ভব একটা বেগুনি নীলকণ্ঠ ( যেই প্রজাতি আমি সারাজীবনে আর কোথাও দেখিনি) , লাল আর ক্রিম রঙের জবা, স্থলপদ্ম , কলাবতী আর অনেক পাপড়ির একটা গোলাপ গাছ ছিল। এককোণে খুব নিচু একটা তুলসীবেদি। লাল সিমেন্টে বাঁধানো। আর বাগানের মাঝখান জুড়ে ছিল একটা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো গোলাপি জবার বিশাল গাছটা । মূল কাণ্ডটা এমনভাবেই বেঁকা ছিল যে ছোট্ট আমি বাড়িওয়ালা জেঠুর হাজার বারণ সত্ত্বেও লুকিয়ে সেখানে বসে দোল আর ম্যাঙ্গো বাইট খেতাম। আর ছিল একটা অব্যাবহৃত সিমেন্টের কুয়ো , যার স্থবির জলে সবজে আলো ফেলত ওই জবাগাছ আর একটা কাগজিলেবু গাছের একসাথে সুখে সংসার করা পাতারা। যখন একটা চাইনিজ কাট চুলের দুষ্টুমিতে ভরা মুখের প্রতিবিম্ব পড়ত সেই মায়ানগরীর আয়নায়, তার গভীর কৌতূহলী চোখে কুয়োর ভেতর থেকে চেশায়ার ক্যাট বা হোয়াইট র্যা বিটের দেখা পাওয়ার অপেক্ষা।
মায়ের হাজারো বারণের মধ্যে অন্যতম ছিল কুয়োয় উঁকি দিবি না। বলা বাহুল্য , তাঁর দুপুরের ঘুমের সুযোগ নিয়ে চুপি চুপি দরজা খুলে সেটিই করা হত। শেষে দেখানো হল ছেলেধরার ভয়। যারা তোষক- বালিশ বানানোর তুলো ধোনার যন্ত্র নিয়ে হাঁক পাড়তেন পাড়ার মাঝে, কেন জানিনা মনে গেঁথে গেছিল তারাই ছেলেধরা। আর ভয় পেতাম কেজিদরে কাগজ কেনার লোকগুলোকে দেখে, বোধহয় ওই সঙ্গের বড় বস্তাটা দেখেই । এমনকি, প্রথম যেবার হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার গল্প শুনলাম বাবার কাছে, মনে মধ্যে ছবিটা সেই ফিরিওয়ালাদেরই একজনের ছিল।
বাড়ির বাগানটা যেন ছিল হারমিওনির সেই ব্যাগটা। সকালে পুজোর ফুল লাগবে তো গাছে হাজারো রকম ফুলের বাহার সারা বছর জুড়ে। টগর , কেতকী, করবী, গন্ধরাজ(ফুল) , লঙ্কাজবা, শুয়োপোকাদের হাউসিং কমপ্লেক্স হওয়া একটা শিউলিগাছও ছিল। শিবরাত্রি তো ধুতরো , আকন্দ, নীলকণ্ঠ সব মজুত। দুপুরে ডাল ভাত তো গাছের থেকে লেবু পেড়ে আনো। কাশি হচ্ছে তো বাসক-তুলসীর রস নিমেষে রেডি । বাড়িওয়ালা এক দিদা তো মাঝে মাঝেই পুঁই , কুমড়ো , লাউ ইত্যাদি গাছ লাগাতেন, রেঁধে দিতেনও সবসময়। তাঁর জাদু ছড়ানো রান্নার কথা আরেকদিন বলব।
বাড়ির পেছনে আবার একটা নিমগাছ , ছাদ থেকে হাত বাড়িয়ে মা পারত নিমপাতা, আর আমি সবজে-হলুদ পাকা নিমফল। নিমফল খেতাম আমি কাকেদের সাথে বসে। একবার তো শরতবাবুর কোন এক ছোটগল্পের থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিমের দাঁতন করার চেষ্টাও করেছিলাম। ব্যাপারগুলো বললে বোধহয় নামী ইংরেজি স্কুলে বন্ধু পাওয়া দুষ্কর হত আমার পক্ষে। অদ্ভুত ব্যাপার, বাড়িটাই যেন শিখিয়ে দিয়েছিল জল হয়ে থাকাটা। কোথায় কেমনভাবে কোন আকারে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে হবে।
তবে খাস ৯৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হয়েও কোনোদিন গ্রামবাংলার বুকের থেকে উঠে আসা কোন গল্পকে মন দিয়ে ছুঁতে অসুবিধে হয়নি। দুটো মাত্র ঘর , তবু আলমারি ঠাসা ছিল ঠাকুরমার ঝুলি থেকে রবীন্দ্র, শরৎ , বঙ্কিম, বিভূতি , শিবরামে। আর চারিদিক জুড়ে ছিল আমার নিজের ওয়াণ্ডারল্যান্ড । এমনি এমনি তো আর বান্ধবীদের স্ল্যামবুকে ফেভারিট বুকের জায়গায় জুলে ভার্ন, কনান ডয়াল এর পাশাপাশি পথের পাঁচালীর নাম জ্বলজ্বল করত না।
বাড়ির উত্তরদিকে ছিল একটা টিনের চালের পোড়োবাড়ি, সাপেদের স্বর্গরাজ্য ছিল জায়গাটা। খুব বেশি মনে নেই, কারণ বড় হওয়ার আগেই ওটা ভেঙে নতুন বাড়ি উঠেছিল। তবু যা মনে আছে, প্রথম ডুমুর গাছ, ফুল, ফল সব দেখেছিলাম ওখানেই। আর ছিল আমার খেয়ে ছুঁড়ে ফেলা বীজের থেকে গজানো একটা বাচ্চা পেঁপেগাছ, কিছু কলাগাছও ছিল বাড়িটার সামনের দিকে। আর ছিল বাড়ির দেওয়াল জুড়ে বট- অশ্বত্থের চারার মাঝেই সদর্পে তরতরিয়ে ওঠা তেলাকুচ আর মানিপ্ল্যাণ্টের ঝাড়। ও , আর একটা কাঞ্চনফুলের গাছ, লাফিয়ে যার পাতা পেড়ে পোঁ করে বাজাতাম আম- আঁটির ভেঁপুর আমার ভার্সন।
বাড়ির পেছনদিকে ছিল আরও একটা বাড়ি যাদের পেয়ারাগাছের অর্ধেক ছায়া পড়ত আমাদের দেওয়ালের এপারে। কাঁচা কষটে পেয়ারার স্বাদ ওখান থেকেই প্রথম পাওয়া।
পাশের বাড়ি থেকে ঝুঁকে পড়া একটা বেলগাছ আর ইউক্যালিপ্তাস ছিল। তাদের পাতা ওপেন ড্রেনটার মুখে লাগাম লাগাতে চাইত চিরকাল। তবে বেল পাকলে কাকের যে কিছু নয়, আর কোকিল যে কাকের বাসা খুঁজে খুঁজে ডিম পাড়ে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবই চাক্ষুশ করার সৌভাগ্য হয়েছিল ওই বেলগাছটার সৌজন্যে।
আরও অনেক গল্প আছে, গাছগুলোর সাথে আমার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার , বা নিমগাছটা কেটে ফেলায় আমার সারাদিনের অসম্ভব কান্না আর সেই প্রথম রাগ করে না খাওয়ার।
তবু এখনও নিজেকে ভাগ্যবান লাগে। বাকি দুনিয়া যখন সবে গপগপাচ্ছে বার্গার, পিৎজা বা হ্যারি পটার, সেই সময়েই আমি চিনেছিলাম থানকুনি পাতা, আম্রপালি , সুপুরিফুলের ইনফ্লোরসেন্সের সেই আচ্ছন্ন করা মায়ের খোলা চুলের মত সুগন্ধটা।
সৌভাগ্য ছিল এতদিন , যে আমার বর্তমান নিজেদের বাসাটিও বেশ একটা গ্রামমাটির গন্ধ নিয়ে ভরে ছিল। চারদিকে পরপর ছটা ফ্ল্যাট উঠে যাওয়ায় আজ হঠাৎ বড় মনকেমন লাগছে।
ও হ্যাঁ, সম্মানীয় পরিচালক মশায়রা, সাউথ কলকাতার এঁদো গলিও “নস্টালজিয়া”-র জন্ম দিতে পারে।