ভুল রাস্তার মোড়ে


Leave a comment

 

এই অযান্ত্রিক সান্ধ্য রাজপথে ,

এই অকালবৃষ্টি-মাখা কালো বিমূর্তের আর্ত চিতকারে;

এই অশ্লীল নৈঃশব্দ্যের আনাচে কানাচে,

আমি তোমার হারিয়ে যাওয়াকে খুঁজছিলাম।

 

সেই এক উগ্র স্নিগ্ধতামাখা বিকেলে,

আমার আগুন রঙ্গা শাড়ি যেদিন আলগোছে আবিষ্ট করেছিল তোমার সত্তা কে,

সেদিনের সেই মহাপ্লাবনের স্রোতে,

হারিয়ে গেছে।

 

আমি ছিলাম বৃষ্টি বেলার কাগজের নৌকো,

তাইআরফিরেতাকাওনি,

আমাকে ভাসিয়েছিলে যখনআবেগের নগ্ন স্বপ্নিলতায়।

 

ভোরের উত্তাপহীন মেঠো পথের শিশির হয়ে বহু জন্ম পার করেছি।

তোমাকে ভুলেছি ।

কিন্তু তোমার হারিয়ে যাওয়াকে নয়।

 

তুমি বদলাওনি , একটুও।

আর তাই আমি বিভ্রান্তের মত আজ ও খুঁজছি,

সেই হারিয়ে যাওয়াটাকে।

 


Leave a comment

আমি বাংলায় জ্ঞান গাই

আমরা যারা ফেসবুক আর নিজেদের বিনি পয়সার ব্লগের বাইরে হালে পানি না পাওয়া “লেখক” , তাদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। ১৪ই হোক বা ২১ , ফেব্রুয়ারিতে কিছু না কিছু আগডুম বাগডুম বিদ্রোহী কচকচানি পোষ্টাতে হবেই।  প্রেম দিবসের অযৌক্তিকতা হোক বা ভাষা দিবসে “বং”সমাজের ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখানো , ফেবু দেওয়াল লিখনে লাইকের সংখ্যাটা ৩০ ছাড়ালেই বেশ একটা “মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে…” গোছের আচিভমেন্ট মনে হয়। তাপ্পর যখন পরিচিত কারোর লেখায় ২০০-২৫০ লাইক দেখা যায়, তখন কাল্পনিক পেন্নাম ঠুকে “গুরুদেব” কমেন্ট করাটা অনিবার্য।

সকালের কাঁচা ঘুমটা যখন পাড়ার ক্লাবের “মোদের গরব মোদের আশা’’ দ্বারা ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হল, মনে মনে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় বাছা বাছা কিছু শব্দ প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে ভাষা দিবসের শুভ সূচনা ঘটল।

একবার এক বন্ধুবর বলেছিলেন, বাঙালি আদর করে বাংলায়, কিন্তু ঝাড়ে ইংরেজিতে। কথাখানা খাঁটি। তবে মাইরি বলছি, আমার বিশ্বাস সেটা স্থান-কাল-পাত্র সাপেক্ষ। ধরুন নব্য প্রেমিকার সামনে ফোন এলো কোন “বাতাসল্যাজ” কোম্পানির নেকাপিনার। তখন ইংরেজি আবশ্যক।  কিন্তু সেই প্রেমিকাকেই বিয়ে করলেন, সুখে থাকলেন ; তখন কিন্তু জিরেগুড়োটা নেই কেন সেই বচসায় শালিমার নারকোল তেলের মত বাংলাই বেরোবে। বা ধরুন ফ্লিপকার্ট আপনাকে জালি ডেলিভারি দিয়েছে। তখন তো শেক্সপীয়ারকে কবর থেকে জাগিয়ে তোলার যজ্ঞের আয়োজন করা অবশ্যম্ভাবী। অথচ “ডাক্তারবাবু কদিন ধরে লুজ মোশান কমছে না ’’-র পরবর্তী আলোচনাটা কিন্ত আপনার সুরুচিসীমা পেরিয়ে অ্যাঁ মরি বাংলা ভাষাতেই হবে। সে আপনি যতই লাল-নীল-হলুদ-(সবুজ) হয়ে যান না কেন লজ্জায়। বেরিয়ে ঝটিতি ইন্টারনেট ঘেঁটে আপনার বাংলা রোগের জার্মান/ জাপানি/ লাতিন পরিভাষা মগজস্থ করে নেবেন, পরদিন সহকর্মীদের শোনাতে তো হবে?

আজকে অনেক “আমার মেয়ে বাংলাটা ঠিক পারে না” বাবলির মা, “ইশ…রবীন্দ্রসঙ্গীত! ” ন্যাকাপিনা, “হ্যাপি ভাষা দিবস টু অল অফ ইউ” ডারপেন্দ্র দের ওপর অনেক ধিক্কার করেছেন সারাদিন ধরে।

আমারও লাগে, খারাপ লাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু এটা ভয় পাবেন না, বাংলা ভাষা মরবে না কোনদিন। আচ্ছা আমাদের মায়েরাও তো তাদের শখ অনুযায়ী সাজগোজ করেন, তা বলে কি ঘুমোতে যাওয়ার আগের আঁচলের মা-মা গন্ধটার তারতম্য হয় কোনদিন?

বিয়েবাড়িতে হয়তো আপনার শিফন শাড়ি আর হল্টারনেক ব্লাউজ অনেক “র‍্যাভিশিং” “সেক্সি” “হট”-এর ছয়লাপ করে দিল। তা বলে কি অষ্টমীর ঢাকাই জামদানিতে মায়ের “তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, কত বড় হয়ে গেলি”-র মাহাত্ম্য কম হয়?

পিজার ওপরের এক্সট্রা চিজ আয়েশ করে “ইয়াম্মিইই…” বলে খাওয়াটা নিঃসন্দেহে স্বর্গীয় , তা  বলে কি শীতের প্রথম নলেন গুড়ের রসগোল্লা মুখে পুরে  অস্পষ্ট “আহা” –র সাথে তার কোন তুলনা হয়?

ব্রেকআপের পরপর পিঙ্ক ফ্লয়েড । হিলিং। জানি। কিন্তু অনেকদিনের পরের আলগা বর্ষার রাতে হঠাৎ ছেয়ে আসা মনকেমনের “ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে…” ; আপনিই বলুন?

“I love you যত সহজে বলা যায়-
“আমি তোমাকে ভালোবাসি” ততো সহজে বলা যায় না।” আমার নয়, হুমায়ুন আহমেদের কথা।

হিচকক। নোলান। স্করসেসি। ঘোর কাটতে সময় লাগে এক এক ক্ষেত্রে। কিন্তু হরিহরের ফিরে আসার পর সর্বজয়ার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েননি, এমন বাঙালি খুঁজে বের করুন তো?

তাই হে বঙ্গবাসী। শঙ্কিত হইবেন না অযথা। আমাদের মা ছিলেন। আছেন। থাকবেন। বেশভূষা বদলান একটু মাঝে মাঝে নাহয়।

ভেবে দেখুন না, আমি খাই ইলিশ পাতুরি, দেশের বাড়িতে গেলে বলি “আইলাম, যাইলাম , অহন, ক্যাডা, পোলা ।’’ লাল-হলুদ ।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু খান পোস্ত । বলেন “ নোব, দোব, এতগুনো , হাঁসপাতাল।’’ সবুজ-মেরুন।

এদের মধ্যে কে বাঙালি নয় ? বলুন দেখি!

আমি লিখি “আছি, করছি, পড়ছি।’’ ময়নার মা বলে “ বুদি, টমাটমের চাটনি কইরেছ আজ? ’’ পশুপতিকাকুর রিক্সায় চাপলে একগাল হেসে বলে, “কুথায় যাবে গো মা? কাল আসো লাই কিনো ? ছুটি ছিল বটে? ’’ পড়াতে গেলে স্টুডেন্টের বাড়ির রান্নামাসি গল্প জোড়েন , “ আমাদের উখানে  মেইদের ১৮-১৯এ বিয়া হই যায়। ইসব চাকরি টাকরি করে না কেউ।’’

বাঙালি বলে অস্বীকার করব কাকে?

তবে সেইভাবে ভেবে দেখলে বাংরেজি কেও অমান্য করতে পারি না আমি।

জনৈক বাংলাদেশীয় বন্ধু বলেছিল ওপার বাংলার, ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘরের সমারোহ, আজকের দিনটায়। কবে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে জানিনা।

ততদিন বেঁচে থাক আমার রাঢ়ী , বঙ্গালী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খণ্ডি , কামরূপী। বেঁচে থাক আমার বাংরেজি। বেঁচে থাক আমার বাংলার মাটি, বাংলার জল। বেঁচে থাক বিশ্ববাংলা। বেঁচে থাক আমার ব এ ওকার , চ এ ওকার। বেঁচে থাক একুশে ফেব্রুয়ারির ছুতোয়  আইবি-র বদলে খাঁটি “বাংলা”র আসর। বেঁচে থাক বাঙালি, বেঁচে থাক বাংলা।

 

পুনশ্চ ঃ অধমের সীমিত জ্ঞান নিয়ে বাংলা ব্যাকরণ ,ইতিহাস, পরিভাষা নিয়ে বাগবিতণ্ডা করবার ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন গুনীজনেরা।


Leave a comment

স্বার্থ

এটা সেই দেশের সেই বৃহদাংশ ভুক্ত মেয়েটার কাহিনী , যে “আঙুর ফল টক” গোছের প্রেম দিবসের বিরোধিতা করে… আবার সুখের সময়ে ঘটা করে “ভ্যালেন্টাইন সেলফি” সাঁটায় ভার্চুয়াল দেওয়ালে। নিজের একটার পর একটা এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অসফল হওয়ার ফাঁকে যার মাথায় জেএনইউ বা ভেমুলা বা চা বাগানের কথা থাকে না। যার কলেজে “পলিটিক্স” নেই বলে গোপন গর্ববোধে লজ্জিত বোধ করে তার বন্ধুদের প্রতিবাদী সত্ত্বার দৃঢ়তার কাছে। যার ঝুলিতে ট্রামে বাসে ট্রেনে অনেক “সম্মানরক্ষার” যুদ্ধজয়ের গল্প থাকলেও , যার বাড়িতে নিত্যদিন বেঁচে থাকার অকথ্য লড়াই সত্ত্বেও তারা আদপে ভীতু… রাষ্ট্র , রাজনীতি, ধর্মীয় নিরপেক্ষতা শব্দগুলো উচ্চারণ করতে। এই তো বেঁচেবর্তে আছি চুপচাপ, কি দরকার পাশের পাঁচ জনের জীবনে নেগেটিভ প্রভাব ফেলার?
মেয়েটা প্রতিবাদ জানায় না কিছুর। বোঝেই না কার পক্ষ নিয়ে , কার বিরুদ্ধ হয়ে কথা বলবে। কোনভাবে কথা বললে শ্যামও থাকবে কুলও থাকবে, মানে কিনা এই সংস্কারযজ্ঞের কাণ্ডারিরা আর ফেসবুক- ইন্টারনেট ছেয়ে ফেলা ‪#‎standwith‬হাশট্যাগে সীমাবদ্ধ প্রতিবাদীরা , কোন পক্ষই গায়ে লাগাবে না। বুঝে উঠতে না পেরে সে চুপ থাকে, তাতেও শিরদাঁড়াহীন বলে চিহ্নিত হয়।
তবু এক একদিন রাত্রে এই মেয়েটিরই মনে হয় এই র্যাতডিকাল টাইম বোম্বে পরিণত হওয়া তার দেশটায় , তার ভবিতব্য কি হত, যদি সেই ছেলেটা এখনও তার জীবনে থাকত? খুব তো শখ করে একদিন ধর্ম জাত পাত মানি না বলে বড় গলা করে দুজনে জুড়েছিল। পারল টেকাতে? সেই তো কয়েক মাসের বাড়ি থেকে পালানোর ধোঁয়াশা প্ল্যান বা নিজের অসুস্থ মায়ের সাথে দাঁতে দাঁত চেপে অসহ খারাপ ব্যবহারের নাটক , কত রিহার্সাল, কত ব্লুপ্রিন্ট… টিকলো কিছু? একদিন তো শুনতেই হল “ আব্বা আম্মু কিছুতেই মানছে না। ” তবু মেয়েটার সেইদিন টার কথা মনে পড়ে। মহরম ছিল। ছেলেটা খুব মুষড়ে ছিল, বলছিল শুধু , “ আমাদের এই দেশটা ছেড়ে চলে যেতে হবে রে, থাকতে পারব না এখানে এরকম জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।’’ তখনও তো মোড়ে মোড়ে পালস পোলিওর মতন গেরুয়াকরন অভিযান শুরু হয়নি। বাচ্চা মেয়েটা ভেবেছিল নিজের বাড়িতে ডেকে নেবে ওকে, ওর পরিবারকে, ওর সমাজকে।
সব নিয়মকে তুচ্ছ করে যখন পারল না, তখন একবার শেষ চেষ্টা করল উল্টোপথে। ছেলেটার হাতে উঠেছিল গীতা, আর মেয়ে টার হাতে অনুদিত কোরান। হল না, জানেন? না হওয়ারই কথা। যুগান্তরের হাওয়ায় রচিত ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না।
স্বচ্ছ ভারতের আড়ালে যখন সংখ্যালঘু অভিযানের ছক কষা হচ্ছে জয় শ্রীরাম ধ্বজাবৃত তলোয়ার-কাটারির গোপন গুদামে, তখন ভারত পাকিস্তান ম্যাচের দিন ভারতের জন্য দুজনেই সোচ্চারে গলা ফাটিয়েছিল। ম্যাচ শেষে আফ্রিদির হতাশ বিবৃতি একইভাবে মনখারাপ করেছিল দুজনের।
অনলাইন গেম খেলার সময়ে কোনো পাকিস্তানি প্রতিপক্ষ থাকলে মেয়েটা খেলার শুরুতে বা শেষ সামান্য অভিবাদন জানাতে ভোলে না, অধিকাংশ দিনই courtesy টা ফেরানো হয় কিন্তু!
এটা শুনে মারতে আসবেন? মেয়েটা পাকিস্তান-সমর্থক বলবেন? বলুন। তবে এটুকু জেনে রাখবেন হিন্দুধর্মটা আপনাদের মত নিরক্ষর নিদেনপক্ষে ক্লাস ফোরের জ্ঞান পরিসীমার থেকে অনেক অনেক বড় আর নিরপেক্ষ ।
মেয়েটা তাই গর্বের সাথে বলে আমি হিন্দু। এবার মেয়েটা ভালো হয়ে গেল তো?
দাঁড়ান।
মেয়েটা সত্যি হিন্দু বলেই সে দলিত, মুসলমান , বেশ্যা সবার সাথে খাবারের থালা ভাগ করে নিতে পারে, জলের গ্লাস শেয়ার করতে পারে। একটা বিধর্মী মানুষকে বিনা দ্বিধায় ভালবাসতে পারে।

প্রথমেই বলেছিলাম , প্রতিবাদ মেয়েটা বোঝেনা। স্বার্থপর । ভীতু। কারণ সে বুঝছে বর্তমানের প্রেক্ষিতে কি ভয়ানক পাপ সে করেছে। তাই সে চুপ, কেঁচোর মত শিরদাঁড়াহীন। প্রাণের ভয়টা তারও আছে কিনা।


Leave a comment

বইমেলা ২০১৬

এক হপ্তা হয়ে গেল ২০১৬ বইমেলার, ভার্চুয়াল কিচিরমিচিরের দৌলতে যাদের জন্য এটি সেলফিমেলা বলে প্রবর্তিত হচ্ছে, তাদের কিছুই যায় আসে বলে মনে হয়না। আমরা যারা সত্যি সত্যি বই কিনলুম বলে ইকো- ফ্রেন্ডলি প্যাকেট উচিয়ে, বাসে অযাচিত লাথি- গুঁতো সহ্য করে বাড়ি ফিরি,   সমালোচনামূলক ফেবু “স্ট্যাটাসের” খসড়া মাথায় নিয়ে , তাদের অবস্থাটিও শোচনীয়। অন্তত আমার মত চিরকালীন হীনমন্যতায় ভোগা পাবলিকরা তো বটেই। পেটুক বড্ড, তবু কাল্পনিক “মান”  বাঁচানোর স্বার্থে ফুডকোর্টে বেশি সময় ব্যয় করা যাবেনা। বহুদিন সঙ্গীটির সাথে ছবি তোলা হয়নি, আবার কবে দেখাসাক্ষাৎ হবে জানা নেই, তবু তোলা হয়না, এই রে কেউ যদি দেখে ফেলে আমাদের নিয়ে পোস্ট দেয়? ঘনিষ্ঠ মহলে অনন্ত ল্যাদখোর সম্মানে ভূষিত আমার অবশ্য স্ট্যাটাস দেওয়ার বিশেষ মনোবাসনা ছিল না।তবু জনৈক অত্যুতসাহী এক ব্যক্তি -_- প্রকাশ্যে আমাকে রেকমেনড করায় এখন পশ্চাৎ রক্ষার্থে এবং উপরোক্ত কৃচ্ছসাধনের পরিপুরক হিসেবে এই পোস্ট দিতে উদ্যত হলাম।

গৌরচন্দ্রিকা অনেক হল, রচনা আরম্ভ।

 

আমার ২০১৬ বইমেলা গমন।

 

ক্লাস থ্রি থেকে শেখানো হয়েছে, যাহা ঘটিয়াছে তাহার ওপর ৩-৪ কোট রং না চড়াইলে রচনাতে ভালো নম্বর পাওয়া যায় না। বেদবাক্য উপেক্ষা করেই পরীক্ষায় বইমেলা কেমন লাগলো তে লিখেছিলুম বই কেনা, খাওয়া দাওয়া, ধুলোস্নান করা (ময়দানে হত তখন) প্রভৃতি । মন্দ পাইনি সেবার। এখন নম্বর পাওয়ার সিন নেই, লাইকের লোভ আছে যদিও, তবুও আরেকবার সত্যচারণ করতে মন চাইছে।

কানে ফুল ভলিউমে লিন্‌কিন পার্ক চলছিল, মেলার কাছাকাছি আসতেই আবার সেই ভয়ে খুলে রাখলুম। ঢুকেই পেটে ২ প্যাকেট জল ও মাথায় অবধারিত সানগার্ড লাগিয়ে  তেনার লেজুড় ধরে প্ল্যান ভাঁজছিলুম, কি করব, কি কিনব, কি খাব ভেবে। গুটিকয়েক পালস পরপর মুখে পোরার ফাঁকে পরিচিত জনদের বইগুলো টপাটপ ব্যাগবন্দী করলুম। জানি যে বিদেশি ভাষার বইগুলো ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজন থেকেই আসবে, তবুও আর ৫টা বাঙালি বোদ্ধার মতো পেঙ্গুইন, অক্সফোর্ড , ক্রসওয়ার্ডের দোকানে ঢুকে  পড়ে ফেলা বইগুলোর ওপর ৪-৫ লাইন বৈমাত্রেয় ভাষায়  জ্ঞানবিচ্ছুরণ করতে লাগলুম পাশের কাঁচাপাকা বয়কাট কুর্তি – জিন্‌স বা সুদর্শন কেতাদুরস্ত ঝরঝরে ইংরিজি ছোকরাকে উদ্দেশ্য করে। বাঁধ সাধলেন সঙ্গীমহাশয়। আমার মতনই কয়েকজনকে দেখে তার দুষ্টুবুদ্ধির উদ্রেক হল। একটি- দুটি সলমান রুশদি বা পামুক বা নাইপল হাতে নিয়ে গোবেচারা মুখ করে “এইগুলা কি লেখা গো? বুজি না তো! ছবিটা ভালো লাগলো তাই দেকলাম। এত্তু বুজিয়ে দেবে? ” শুরু করলেন। পাশের শর্ট ড্রেস – লাল লিপস্টিক- হাতে আয়ান র‍্যানড / পাওলো কোয়েলহো -র  বিস্ফারিত “ডিসগাস্টেড ”  নজরের সামনে তখন কলাগাছ  শুকিয়ে আঙুল। অবশেষে জীবনে প্রথমবার মহাশয়ের পদাঙ্ক অনুসরন করলাম। বিশ্বাস করুন, ছেলেবেলার ভরদুপুরের আচার চুরি করার মত অদ্ভুত একটা আনন্দ হল।

 

তারপর আরও অনেক কিছু ঘটেছে , রটেছে , ফেটেছে।

 

চিংড়ির পাকোড়ার নামে বিস্বাদ আটার দলা  গলাধঃকরন করে দুজনে যখন হাসছি, চোখে পড়ল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টল। তার সামনে দাঁড়িয়ে সেন্সর-বিরুদ্ধ কাজ করবার মতলব করছি , দেখলুম এক হিজাব- বোরখা পরিহিত ভদ্রমহিলা তার মেয়েকে নিয়ে স্টলের সামনে গিয়ে বসলেন নির্বিকারভাবে। ঢিপঢিপ বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কেটে গেল অনেকক্ষণ। স্টলকর্তারাও নির্বিকার।

বইমেলা। 🙂

 

প্যাভিলিয়নে ঢুকে ডাকফেস সেলফিতে ফটোবম্ব বা বলিভিয়ার রাজধানী ভুলে যাওয়ার মত “ইরেলেভান্ট ডিটেল ” দিয়ে আর বোর করব না। তবে অনেকদিন পর মনে হল চোখটা একটু বড়ভাবে খুলল । ক্রেডিটটা নবকলেবর নব্যবাঙালির শেষ শীতের চিরন্তনী কার্নিভাল বইমেলার প্রাপ্য। ভালো লাগলো অনেকদিন পর। আমার কথাটি ফুরল। ইতি টানলুম রচনায়।

দেখি কত নম্বর পাই।

 

পুনশ্চঃ খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু নানা কারনে সম্ভবপর হল না, এই বইমেলায় আমাদের নতুন বই ” বৃষ্টিভেজা রুপকথারা” প্রকাশিত হওয়ার। তবে সদ্য আসতে চলেছে, গতানুতিক ভালোবাসার গল্পের বাইরে বেরিয়ে এক ফেব্রুয়ারি স্পেশাল সংকলন ,  কিছু ডানা মেলা অচেনা পাখি। পড়ে দেখুন বা উপহার দিন, ভালো লাগবে । 🙂


Leave a comment

ভেজা মাটির গন্ধ

 

“আমি কোনদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি কারও সাথে কাটাইনি জানিস ? ’’ প্রথম পরিচয় ফেসবুকে, প্রথম দেখা ছিল ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে ; জিওলজি গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে নির্ঝরকে বলেছিল মেয়েটা।

নির্ঝর উত্তর দেয়নি, হালকা হেসে আলতো করে ছুঁয়েছিল কাঁধের কোণ, আর সেই পাগল করা নেশা নেশা মাটির গন্ধটা পেয়েছিল প্রথমবার, ওর চুলের থেকে। মাটির গন্ধ জানে নির্ঝর, কিন্তু এরকম মাতাল করা মাটির গন্ধ কোনদিন পায়নি ।

মেয়েটা স্নিগ্ধ হেসেছিল।

জুনের ভিজে শার্টের দুপুরবেলাতেও একপলক বরফপাত।

 

“এইটে আমার সবচেয়ে আপন গান ’’ , বলে শ্রাবণের ধারার মতো গান গেয়েছিল মেয়েটা। নিখুঁত গায় না, তবে অসম্ভব রকমের একটা মেঠো গন্ধ পেয়েছিল নির্ঝর।

“ তোর নামটা কি সুন্দর, চুপ করে  ভিজতে ইচ্ছে করে।’’ তখনও বর্ষা আসেনি মহানগরীতে, তবু মেয়েটা চোখ বুজে  দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রিন্সেপ ঘাটের থামটায় ভর দিয়ে। বড় বড় নিঃস্পন্দ একরাশ চোখের পাতায় সেদিন জিওস্মিনের গন্ধ মেখে মেঘ ঘনিয়ে এসছিল। নির্ঝর অবুঝের মতন ছুঁয়ে ফেলেছিল , ভেজা মাটির ঠোঁট দিয়ে, প্রথমবার।  মেয়েটাও।

মেয়েটা চোখ খুলল যখন…… কলকাতায় তখন রিকশাওয়ালা পলিথিনের ছাউনি টানছে , কলেজ স্ট্রীটের ফুটপাথে অপ্রস্তুত তড়িঘড়ি, উত্তর কলকাতার ছাদে শুকনো কাপড়ের তোড়জোড়ের মাঝে একরাশ স্বস্তি, ময়দানে ফুটবল পায়ে উল্লাস , স্কুলের  জানলায় আনমনা প্রথম প্রেম  …  প্রথম বৃষ্টির কলকাতা।

 

তারপর ছিল নতুন সবুজ ঘাসের ওপর খবরের কাগজ আর খালি পা , ভিক্টোরিয়াকে সাক্ষী রেখে অলিখিত  আলিঙ্গন।  উন্নাসিক মেঘের চাদরকে উপেক্ষা করে ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে বসে ছিল নির্ঝর। এককোণে তখন ধুলো আর ঝরা পাতার ষড়যন্ত্র , বিদ্যুতের লুকোচুরি । ঝড়টা আছড়ে পড়তেই মেয়েটা মুখ লুকিয়েছিল নির্ঝরের বুকে। নির্ঝর আবারও হার মেনেছিল ওই মেঘ কালো চোখের পাতার কাছে।

প্রথমবার কালবৈশাখী অভিসার । বর্ষার দিব্যি রেখে।

 

একদিন ছিল মনখারাপ ।

“ কলকাতা আর বর্ষা, শব্দ দুটো মিলিয়ে দিলে কারও কারও মনে আসে জমা জল, ম্যালেরিয়া আর ইলিশ মাছ। আবার কারও মনে হয় ঝাপসা কাঁচ , মেঘলা ছুটি , আলগা ঝড় । তুই কোন ক্যাটাগরি?’’ সিগারেটের ধোঁয়াটা  নির্ঝরের নাগালের বাইরে ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিল মেয়েটা।

নির্ঝর  হেসেছিল শুধু, “তুই? ’’

“ কলকাতা আর বর্ষা মানেই  মনখারাপ । ’’ মেয়েটা আনমনে আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে বলেছিল, নিরুত্তাপ ভাবে যোগ করেছিল , “চল আজ তোর বাড়ি যাব। ’’

সেদিন চিলেকোঠায় ধুলো আর নস্টালজিয়ার আবরন, পুরনো তক্তপোশ আর ছেঁড়া তোষকের বৈরিতা । খোলা জানলার অনিয়মিত বৃষ্টির ছাঁট, তার মাঝে মিশে গিয়েছিল ঝরনা আর বৃষ্টি আর মেঠো আর নেশা নেশা আর মনখারাপের গন্ধ। নির্ঝর সেই প্রথম বুঝেছিল ওর প্রিয় ঋতু বর্ষা, স্কুলের খাতায় লেখা শরৎ নয়।

 

“আজ অফিস যাস না, কলেজ স্ট্রিট যাব চল। ’’ মেয়েটা বোধহয় খবর দেখত না।

“ আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা। জানিয়েছেন আবহাওয়া দফতর প্রধান ……” যান্ত্রিক সুরে দূরদর্শনে খবর শুনেছিল নির্ঝর। গত ভোটের পর থেকে প্রতিযোগী দুই সংবাদ চ্যানেলের দ্বৈরথে বিতৃষ্ণ হয়ে বাবা এই পন্থা নিয়েছেন।

সেদিন কলেজ স্ট্রিট ভেসে গিয়েছিল। মহাপ্লাবনের প্রাকমুহূর্তে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল মনখারাপি মেয়েটা, এককোমর কালো জল ঠেলতে ঠেলতে । নির্ঝরের মুখে তখন দিওয়ালীর প্রথম জ্বলা প্রদীপ।

সেদিন শহরের উগরে দেওয়া নৈঃশব্দ আর নিষ্প্রাণতা জলে ভেসে হেডলাইন বানিয়েছিল পরদিন। কাকভিজে দুটো প্রাণী পরিত্যক্ত বেঞ্চের কোটরে বসে সংসার সাজিয়েছিল…… কুর্তি – জিন্‌স , dunhill, টেরাকোটা কানের দুল আর ২-৩-৫ মাসের সম্পর্ক দিয়ে defined একটা মেয়ে প্রথমবার মেয়ে হলে কি নাম রাখব আবৃত্তির ফাঁকে কক্সবাজারের সূর্যাস্ত হয়েছিল, নির্ঝর মনে মনে অ্যালবামের পাতা ওলটায় আজও ।

না, এটা ঠাই পায়নি কোন লেখকের এন্ডিং লাইনের ভেতরে।

তারপর ছিল শিয়ালদা ফুটপাথ , চিংড়ির আর টম্যাটোর চপ, দুধ চা আর মেঘপিওনের লুকিয়ে পড়া চিঠির  দিস্তা।

আরও একটা বৃষ্টি হয়েছিল কুমোরটুলির একটা রংচটা সবুজ পলিথিনের তলায়। ছাতা নেয়নি সেদিন

কেউই । নির্ঝর ওই আঁধার কালো চাহনির সামনে DSLR বের করার সাহস পায়নি। ওরা কথা বলেছিল, সোমেন পাল, ভগীরথ পাল, কাঁচাপাকা দাঁড়ির গোপাল ভটচাজের সাথে। মেয়েটা একটা রুপোলী জরির মুকুটের মধ্যে চুমকি বসিয়েছিল একটা বাচ্চা ছেলের সাথে । তারপর একটা ছেলেবেলার বৃষ্টি নেমেছিল, গ্রামের বাড়ি ,খালি পা, ধানের খেত , খড়ের চালের লাউগাছ পেরিয়ে। স্মৃতিবিদ্ধ নির্ঝরের সম্বিত ফিরেছিল পুজোর গন্ধ আর মাটির গন্ধ মিশে যাওয়ায়, ওর কাঁধে রাখা মাথায় মাথা ঠেকিয়ে।

 

শেষ বৃষ্টিটা হয়েছিল অচিনপুরে । মেয়েটা সেদিন চুল খুলে এসেছিল, শ্যাওলা রঙের একটা শাড়ি। একটা বেপাড়ার বাসে জোর করে উঠিয়েছিল ঘন ঘন ঘড়ি দেখা নির্ঝরকে। তারপর আবার নেমে গিয়েছিল অচেনা  শহরতলিতে। একটা নাম না জানা মাঠ , তার পাশে সুখ – দুঃখের  দীঘি। কিচিরমিচির নিস্তব্ধতায়  ডুবে গেছিল রোজনামচা । তারপর এবছরের শেষ বৃষ্টি হয়েছিল চরাচর জুড়ে । মুগ্ধ দুচোখ জুড়ে। দুর্গার শেষ ভেজা বৃষ্টির মত নিষ্পাপ বর্ষণধারা আর ভেজা মাটির গন্ধ।

 

শরৎ , হেমন্ত , শীত । ফিকে হতে হতে প্যালেটের রংগুলো সব একে একে মুছে ধুসর হচ্ছে। গন্ধটা যেন দূরে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। এপারের না বলা ঝোড়ো হাওয়ারা ওপারের এক অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠা কাঁচের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে বিঁধছে কনকনে নিষ্ঠুর শীতের হাওয়া হয়ে।  উপন্যাসটা অনিয়মিত হয়ে হয়ে ছোটগল্পের মর্যাদাটুকুও যেন হারাতে চাইছে, নির্ঝরের মনে হল।

ডিসেম্বরে মেয়েটা এসএমএস করল , জন্মদিনের আগের রাতে। নির্ঝর তখনও ওর নিজের হাতে বানানো ক্যালেন্ডারটা রিবন আর জিজ্ঞাসাচিহ্ন দিয়ে বাঁধতে ব্যস্ত।

“ নির্ঝর আই ডোন্ট থিঙ্ক ইটস ওয়ারকিং আউট এনি মোর। সরি। ভালো থাকিস। ’’

 

অপ্রত্যাশিত ছিল না হয়তো। তবু লাগল । খুব জোর লেগেছিল।

ফোন তোলেনি মেয়েটা।

তারপর কখনও মাতাল হয়নি নির্ঝর আর ।

তারপর যেমন হয়।

পিঙ্ক ফ্লয়েড, ইনসোমনিয়া, অ্যান্টি- ডিপ্রেসেন্ট।

একটা হিমবাহর তলায় চাপা পড়ার আগের মুহূর্ত অবধি বহু অবান্তর অলীক আশার ইতস্তত বিচ্ছুরন।

তারপর একদিন বাতাসের কানে কান না পেতেও শুনতে পেল নির্ঝর অদৃশ্য আলোর রোশনাই, আর নতুন খাতায় লেখার মতো একঝাক খুশি; মেয়েটার লাল শাড়ি আর পানপাতায় ঢাকা মুখ, আর তার আড়ালে মেঘ কালো আঁধার কালো চোখ ।

 

হিমবাহ আর সারনেম নিয়ে নির্ঝর পাড়ি জমালো নিরুদ্দেশে। দশটা- সাতটা, ভিড় মেট্রো, রোববারের বাজার আর বাবার ওষুধের মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে ওঠা বিষাক্ত কলম আর লোকগীতি হয়ে।

নির্ঝর মুখোশ পড়ে নিল। আর পাঁচজন হওয়ার মুখোশ। যেই পাঁচজন মায়ের মন রাখতে যায় একের পর এক বাড়িতে, সব মৃন্ময়ীর মাঝে আঁধার কালো চাহনি খোঁজার অজুহাতে চায়ের কাপে লুকোয়ে কান্না, আর “ না আমার পছন্দ নয়” বলে মিথ্যেই ফাঁপা পৌরুষের ভান দেখায়।

 

দূরদর্শনের খবরে বলছে, এবছর ৪ঠা জুলাই  অফিসিয়াল ডেট ছিল, বর্ষা আসার, কিন্তু এখনও আসেনি। নির্ঝর টিভি টা বন্ধ করে দিয়ে চিলেকোঠার জানলায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে গর্জন, মৃদু। মেঘের। আজ আর রোমাঞ্চ বা সংকোচ , কোনটাই নেই মেঘের, নির্ঝরের কাছে। দুজনেই আজ নিরুত্তাপ, প্রশান্ত। পাশের নতুন ফ্ল্যাট থেকে “শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে’’-র আলতো শ্লেষ ভেসে আসছে। মা ছাতের টবে গাছ লাগিয়েছে। বাহারি ফুলগাছ , শৌখিন পাতাবাহার। সেই না দেওয়া জন্মদিনের ক্যালেন্ডারটা ঘরটার এককোণে ধুলোমাখা অবহেলায় ম্রিয়মান। নির্ঝর মৃতপ্রসবিত শিশুর মত ওকে তুলে আনে, পাতাগুলো উলটে উলটে আজকের তারিখে থমকায়, আজ সেই প্রথম বৃষ্টির কলকাতা  আর ভেজা মাটির ঠোঁটের রেড লেটার ডে।

টবের ক্যাকটাস এ নতুন পাতা?! ছোট, ছোট, প্রায় ইনভিসিবল , তবু পাতাই তো! আগে কোনদিন স্বচক্ষে ক্যাকটাসের পাতা দেখেনি নির্ঝর। কি একটা অসমাপ্তির অসস্তি হচ্ছে ভেতরে হঠাৎ করে।

ফোনটা পকেট থেকে বের করে নাড়াচাড়ার ফাঁকেই কেমন নিষিদ্ধ আকর্ষণের মত বেরিয়ে পড়ে M এর কনটাক্ট লিস্ট।

হিমবাহ ভাঙতে ভাঙতে একটা কল যায় নাম্বারটায়।

শেষ অক্সিজেনটুকু সঞ্চিত রাখার প্রতিশ্রুতির কয়েকটা  মুহূর্তের অপেক্ষার ওপারে ফোনের একটানা রিং এ বাধা পড়ে। একটা বহুল পরিচিত , বহুল প্রতীক্ষিত হ্যালো।

“নির্ঝর, একবার দেখা করতে পারবি? ’’ এক নিঃশ্বাসে কালবৈশাখী ধেয়ে  আসে।

চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝর, কোঁকড়া চুলে জড়িয়ে যাচ্ছে কলকাতার প্রথম বৃষ্টি। নির্ঝরের হুঁশ নেই, ওর আজ আকাশ বাতাস দিগন্ত জুড়ে শুধু ভেজা মাটির নেশা নেশা গন্ধ ।

 

 


Leave a comment

পুজোনামচা

পুজোনামচা – ১

ষষ্ঠী

লেবু চা, পুতুল নাচ আর স্ট্রিটলাইটের মা

বেরিয়েছিলুম আজ, ষষ্ঠী, থুড়ি মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায়। কি যেন বলি আমরা? প্যান্ডেল হপিং। দেশপ্রিয় পার্ক না হয় বন্ধ, তার জন্য সেই শুক্রবার সাড়ে ছটার কাটোয়া লোকালের ভিড় টা নেই; তবে কিছু কমতি নেই মানুষের উৎসাহে। ঝলমলে নয়নাভিরাম আলোকসজ্জা, রীতিমত গভীর self-analysis এ নিমগ্ন  করে দেওয়ার মতো থিম, নামকরা শিল্পীদের নজরকাড়া শিল্পনৈপুন্যে ঋদ্ধ এক একটা পুজো । কেউ কারোর চেয়ে কম যাওয়ার পক্ষপাতী নয়। প্রতিবছর একই চেনা জায়গাগুলোর আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে  ওঠাটা সবসময়ই কেমন একটা আশ্চর্য লাগে। যেহেতু কিছুদিন আগেই কয়েকজন বাচ্চার মুখে পুজো- নামাঙ্কিত হাসিটা ফোটানোর একটা ছোট প্রচেষ্টা নিয়েছিলুম, নিয়মমাফিক আমার উচিত ছিল পুজোতে আনন্দে যাকে বলে উদ্বেলিত না হয়ে ওঠা। যে ছেলেটার থেকে ধুপকাঠি কিনলুম সহানুভূতি দেখিয়ে, বা যেই ভিখারি বাচ্চাটাকে আমার চকোলেট টার অর্ধেক ভাগ দিলুম, বা যেই মেয়েটা আমার আইসক্রিমের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে ছিল…হয়তো উচিত ছিল আরও একটু মুখ বেজার করার, আরও দু-এক ফোঁটা আড়ালি চোখের জল ফেলার। হল না, জানেন তো! কিছুতেই পারলাম না নিজের উচ্ছলতাকে দমন করতে, বুঝলুম বড় হওয়া বাকি রয়ে গেছে। বরং কেমন একটা আনন্দ হল, রঙচঙে সবুজ জামাটা পরে যে ক্লাস ৫ বাবার সাথে প্রথম কলকাতার পুজো দেখার বিস্ময়কে লুকোনোর কাঁচা অভিনয় করে বড় হয়ে গেছি ভাব নিয়ে , “এদিকে আসুন, লেবু চা, লেবু চা” করে হাঁক পাড়ছিল, তাকে দেখে; তার সন্তর্পণে এগিয়ে দেওয়া প্লাস্টিকের  চায়ের কাপে ধাক্কা খেয়ে ঠিকরে বেরনো রামধনু আলোয় উজ্জ্বল দুটো চোখ দেখে।

হিন্দুস্থান পার্ক সার্বজনীন এর প্যান্ডেল টা কটা পুরষ্কার পেয়েছে জানিনে, তবে স্বাদটা এখনও লেগে আছে মায়ের হাতের ভোগের পায়েসের মত। মেলা দেখেছি ছোট থেকে অনেক, তবে ওই টয়ট্রেন , ব্রেকডান্স, প্লাস্টিকের নিত্যনতুন খেলনার সম্ভারে আক্রান্ত আমার মেলা- স্মৃতি। মা-র কাছে শুনতুম , মায়ের ছোটবেলার মেলার পুতুল নাচে রামায়ণ, রথের মেলার তালপাতার পাখা, চার আনার নির্ভেজাল উচ্ছ্বাস, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল, আশ্চর্য জাদুকরের ভেলকি, লক্ষ্মীসরার গল্প। সব দেখলুম ওখানে! নিজের ইমাজিনেশনের এরকম জলজ্যান্ত প্রজেকশন জীবনে খুব কম উপভোগ করে বিস্মিত হয়েছি।

পুজোর সাজে মেকওভার পাওয়া কল্লোলিনীর চেনা গলিকেও অচেনা ভেবে হারিয়ে যাওয়ার বাতিকটা এখনও বহাল আমার। সেখানেই পুজো- পুজো লাইট- সাউন্ড আবহের বাইরের এক স্ট্রিটলাইট চোখে পড়ল। হলুদ আলোর নীচে ছেঁড়া শাড়ির মাতৃরূপেন সংস্থিতা। আর এক নতুন লাল জামার ছোট মেয়ে।  হয়তো বড় পুজোর জৌলুস গায়ে মাখার অলিখিত পাসপোর্টের লিস্টে ওরা ব্রাত্য। “মা এবার খাব?”

“না এখন খুলিস না এটা।“

“মা খাই না, দাও না খেতে…”

“আচ্ছা আচ্ছা যা…” কথা শেষ হওয়ার আগেই ছিঁড়ে ফেলা একটা দশ টাকার চিপসের প্যাকেট। আর উন্মুক্ত অনেকটা আনন্দ…আনকোরা, নিখাদ, উচ্ছল।

পুজো এসে গেছে যে।।


Leave a comment

কাঠবেড়ালি

অদ্য শ্রীমান শতদ্রু মহাশয়ের চাউমিন প্রস্তুতিতে হাতেখড়ি ঘটিল।

 

এবং সেই অদ্ভুত কিছু সবজি সহযোগে বেশ উপাদেয় খাদ্যবস্তুটির পৃথিবীর আলো দেখা সার্থক করলাম আমি এবং এক অপ্রত্যাশিত অতিথিদ্বয় । এক কাঠবেড়ালি দম্পতি।

 

গাছের গুঁড়ি তে ঠেস দিয়ে বসে সারাদিনের অভুক্ত প্রত্যাশা-র সঙ্গে পরম উৎসাহে পাচকের জিজ্ঞাসু উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি আড়চোখে উপেক্ষা করে এক দুই তিন করে চামচ মুখে পুরছি ; আর পাচক মহাশয়ের আমার থেকে প্রশংসা পাওয়ার আশা ক্ষীণতর হওয়াতে যখন তিনি নির্লিপ্ত ভান করে এদিক ওদিক দীর্ঘশ্বাস ছড়াতে ব্যস্ত, হঠাৎ তার দৃষ্টিগোচর হল এক নিরীহ কাঠবেড়ালি অত্যন্ত প্রত্যাশী ভঙ্গি তে আমার চাউমিন খাওয়া দেখছে। তার নির্দেশে এক চামচ অতি সন্তর্পণে মাটিতে নিক্ষেপ করা হল। কাঠবেড়ালি মশাই ইতিউতি চেয়ে এক লাফে নেমে এলেন গাছ থেকে। আর একটু গা চুলকে ল্যাজ নাড়িয়ে গোঁফে চাড়া দিয়ে শুরু হল তার ভোজনপর্ব। আমরা দুজন খাওয়া থামিয়ে দেখলুম বেশ সেটা । খুঁটে খুঁটে অতি দ্রুত চাউমিন এর টুকরো গুলো খেয়ে তিনি দু হাত দিয়ে ধরে ডিমের টুকরো টা বেশ একটু কায়দা করে খেলেন। আমি উদ্বেলিত হয়ে তাকে আরও খানিকটা খেতে দেওয়াতে দেখলুম তিনি আর পালাচ্ছেন না, বেশ বীরদর্পে রাজকীয় ভঙ্গিমায় খাচ্ছেন পরম সুখে। শতদ্রু বাবু কে দেখলুম বেশ খুশিখুশি , আমি না হলেও কাঠবেড়ালিটি তার পরিশ্রমের মর্যাদা দিল বলে কথা । তার অতি উৎসাহে কাঠবেড়ালি কে গাজরের টুকরো দেওয়া হলে সে সসম্মানে তা প্রত্যাখান করল। এবং হঠাৎ ই প্রস্থান করল। আমরা খানিক আশাহত হলেও বেশ লেবু চা নিয়ে গুছিয়ে বসেছি;

ওম্মা!!! কী কাণ্ড!! কাঠবেড়ালি তার অন্তঃসওা অর্ধাঙ্গিনী কে নিয়ে হাজির। কাঠবেড়ালির ইচ্ছে ছিল বোধহয় একসাথে বেশ জমিয়ে লাঞ্চ সারবেন; কিন্তু সম্ভবত দাম্পত্য কলহের দরুন ( শতদ্রু-র থিওরি) কাঠবেড়ালিনী তাকে এক ধমকে তাড়িয়ে দিলেন, এবং তারপর একইভাবে তার ভুরিভোজ সারতে লাগলেন। শতদ্রুর সমগ্র পুরুষ প্রজাতি দের সংসারে এক ই দশা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মাঝেই তার খাওয়া কমপ্লিট করে এক ফেলে দেওয়া চা এর ভাঁড় থেকে কয়েক ফোঁটা চা খেয়ে আবার দূরে করুণ চোখে অপেক্ষা করা বর মহাশয় কে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন গাছের ডালে।

 

পুনশ্চঃ ভাবছি আজকের এই অভিজ্ঞতা টা শিক্ষামূলক ক্যাটাগরি তে রাখব কিনা


Leave a comment

নিমফল

 

“মিঠি নিমফল খাবি? ” রানা একগাল হাসল।

“ইস কি তেতো! খায় নাকি ওগুলো কেউ? তুই কি পাগল রে! ’’ মা-র জোর করে খাওয়ানো নিম-বেগুন ভাজার কথা মাথায় আসতেই মিঠির ওক উঠল।

“তুই কি বোকা। নিমফল তো মিষ্টি, নিমপাতা তেতো হয়। ’’ রানা সদর্পে বুক ফুলিয়ে জানান দিল।

“তাই?” চোখ গোলগোল করে তাকায় মিঠি।

“চল চল, ওই ঘোষেদের নিমগাছটায় উঠে আমি গাছ ঝাকান দেব, তুই নিচে দাঁড়িয়ে ফলগুলো কুড়াস। ’’

মিঠি নাচতে নাচতে চললো রানার পেছন পেছন।

“এইই আস্তে আস্তে আয় । শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ শুনতে পাবে। ’’ রানা ফিসফিস করে সাবধান করে মিঠিকে।

মিঠি অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু বাবার কিনে দেওয়া নতুন লাল বো দেওয়া জুতোগুলো এমনিতেই এত মচমচ আওয়াজ করে। মিঠির রাগ হয়, রানার ওপর না জুতোর ওপর বুঝতে পারেনা।  রানার কি ভাল, জুতো পড়তে হয় না, ওর মা বকেও না পায়ে ধুলো লাগলে । মিঠি মুখ গোঁজ করে এগোয়।

“দাঁড়া দাঁড়া, এইখানে। ’’ বলেই রানা লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে চড়তে থাকে। মিঠি হেসে ফেলে।

একটু ঝাঁকা দিতেই কত্ত কত্ত নিমফল টুপটাপ করে মিঠির গায়ে মাথায় পড়তে থাকে। খিলখিল করে হাসে ও ।

“অ্যাই , তোকে কুড়োতে বললাম না? ’’ রানা নেমে এসেছে ততক্ষণে , এসেই একটা কানমলা মিঠিকে ।

“ লাগছে ছাড় ছাড়, বাবাকে বলে দেব। ’’ মিঠি ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগে।

“বলগে যা। কাকু আমাকে লজেন দেবে, কিচ্ছু বলবে না । ’’

মিঠি কথা না বলে নিমফল কুড়োয় । রানাও অনেক জড়ো করে ময়লা হাফপ্যান্টের  পকেটে পোরে। “চল , আর কাঁদুনিবুড়ি হতে হবে না। ঝিলের পাড়ে চল। ’’ রানা হাত ধরে টান লাগায়।

দুজনে হাত ধরে দৌড়োয় । কাশীনাথের মাঠ , মিত্তিরদের বাঁশবাগান পেরিয়ে তারপর একটা পাটখেতের আল ধরে হেঁটে গিয়ে হল ঝিল।

ঝিলের পাড়ে বসে প্রথম নিমফল খায় মিঠি, খুব ঘেন্না করে। ওমা , পলকে মুখে হাসি। “কি মিষ্টি রে!’’

দেখতে দেখতে দুজনেরই কোঁচড় খালি; পা দুলিয়ে বসে কলমির ঝোপের ওপর লাল ফড়িঙের ওড়াউড়ি ।

“দাঁড়া তুই’’ বলে উঠে যায় রানা। মিনিটখানেক পরেই হাজির হয় কিসব একটা ফুল নিয়ে। সাদা , ছোট। রেললাইনের ধারে অনেক ঝোপ হয় এই ফুলের।

“এই দ্যাখ, এটা এভাবে নাকে পড়তে হয়। ঝুম্পিদিদিকে দেখেছি।’’ রানা ফুলটা মিঠির নাকে আলতো করে লাগিয়ে দেয়। মিঠি হাসে।

“তোকে না পুরো সিদেবী লাগছে। ’’ রানা চোখ মারে।

মিঠি ভয় পেয়ে যায়, টিচার বলেছে চোখ মারা খুব খারাপ জিনিস।

 

 

 

“এইটুকুন খেয়ে নাও তিতির, স্কুলে টপ করতে হবে তো। আর তারপর সুইমিং ক্লাস,… ’’

“না আর খাব নাআআআ! ’’ তিতির টেবিল থেকে উঠে দৌড় লাগায় , এখন চলবে ডাইনিং জুড়ে ছোটাছুটি , একজন মুখে খাবার নিয়ে, আরেকজন প্লেট হাতে। এক নিয়ম রোজ। ভালো লাগে না মিতালির।

“বাবান বাবান …” লাফাতে লাফাতে তিতির গিয়ে জড়িয়ে ধরে সঞ্জয়কে।

“ওলে বাবা লে, আমার পুচু সোনাটা খেয়েছে? ’’

“ সেই শান্তি কি আমার আছে? ’’ মিতালি গুমরোয় পাশ থেকে।

“খেয়ে নাও সোনা, নাহলে কি করে taller, stronger, sharper হবে? ’’ তিতিরকে কোলে তুলে বলে সঞ্জয়।

“ বাবান মা আজকে আবার আমায় papaya খাওয়াচ্ছে। ’’ তিতির কমপ্লেন জানায়।

“ ওকে, আমার সোনাকে খেতে হবে না papaya, আর আমার সোনা আজকে আমার কাছে খাবে। ’’

তিতিরের হাততালির মধ্যে সঞ্জয় মিতালির হাত থেকে প্লেটটা ছিনিয়ে নেয়।

“মেয়েটার সামনে atleast normal behave….’’ মিতালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় দ্রুত।

আজ ১০:৩০ টায়ে  ফার্স্ট ক্লাস, মেয়েকে স্কুলে ড্রপ করতে তো মিতালিকেই হবে। কোনদিন দায়িত্ব নিয়েছে সঞ্জয় একফোঁটাও ? মেয়ের ৪ মাস বয়স থেকেই তো উনি ওদেশে , ওকে স্কুলে ভর্তি, নিজের কলেজ, কম সামলেছে একার হাতে মিতালি ? এখন ইন্ডিয়াতে ফিরেও কি একদিনও সংসারে এতোটুকু contribute করেছে? আর এখন তো, থাক ওসব।

বডি ওয়াশের নরম গন্ধ আর ঈষৎ উষ্ণ শাওয়ারের জলে ডুবে যেতে থাকে সারারাতের ক্লান্তি।  হাঁটুর কাছে আর ঘাড়ের কোণে এখনও কালশিটে । জ্বালা করছে সাবানজল লেগে। মিতালি দাঁত চেপে থাকে। তিতিরটা আরেকটু বড় হোক।

ফ্ল্যাটের পেছনে ফাঁকা জমি আগাছার ঝোপে ভরে আছে। কোথা থেকে একটা জংলা পারথেনিয়ামের গন্ধ সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে ভেসে আসছে। মিতালি হারিয়ে যায় , অতলে।

 

 

“ বাবা মিঠিকে টিভিতে দেখলেন? ওই মাধ্যমিক রেজাল্টের পর? ’’ মা দাদুকে প্রনাম করতে করতে বলে।

“হ্যাঁ গো বউমা, দেখলুম মিঠিসোনাকে । ’’ দাদু মিঠির মাথায় শীর্ণ হাত বুলিয়ে দেন।

“দিদিভাই, নাড়ু খাবি? ’’ ঠাম্মা ডাক পাড়েন দরজার আড়াল থেকে।

“তিলের নাড়ু আছে ঠাম্মা? ’’ মিঠি হরিনপায়ে অদৃশ্য হয় পর্দার আড়ালে।

“ দেখেছ? আরে মেয়েটা , স্নানটা করে নে তো! কতক্ষণ ট্রেন জার্নি করে এলো… কোন বুদ্ধি আছে? ’’

“থাক বউমা, কতবছর পরে এলো বলো তো মেয়েটা। ’’

“হ্যাঁ দু বছর প্রায় ।’’ বাবা জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে উত্তর দেয়।

 

দুহাতে চারখানা নাড়ু নিয়ে মিঠি চুপিচুপি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পরে। এখন ভরা রোদ, কিন্তু দাদুদের এই আমবাগানটা সারাবছর ছায়া ছায়া। পাকা পাকা সিঁদুরে আম ঝুলছে সব গাছ থেকে। ধুর এত্তদিন এই পড়া পড়া করে আটকে রেখেছে মা বাবা, মনটাই ভালো হয়ে যায় এখানে আসলে।

মাটির রাস্তাটার শেষে বাদিকে রানাদের ঘর । টালির চাল, ছিটেবেড়ার দেওয়াল। উঠোনে এক কোণে বাতিল ঝুড়ি , প্লাস্টিকের কাপ,বালতি ডাই করে রাখা, আরেকদিকে ওদের পোষা হাঁসের ঘর। কত খেলেছে মিঠি ওদের উঠোনে। আর ওর মা কি দারুণ রসুনের আচার বানায়। মাঝে মাঝেই মা কে না বলে রানার সাথে বসে শাপলা, কচু , আচার , লঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছে কত! আজকে সেসব মনে পড়ে খুব খুশি লাগছিল মিঠির কেন জানি।

 

দুবছর আগে একদিন বিকেলে রানার সাথে সেই ঝিলে গেছিল মিঠি। রানার বন্ধু বিলু, ওর বাবা মাছ ধরে। একটা ডোঙা ভেড়ানো  ছিল পাড়ে, বিলুর বাবার। খুব সন্তর্পণে উঠেছিল দুজনে, একটু এদিক ওদিক করলেই সোজা জলে। রানা ওপাড়ে নিয়ে গিয়েছিল। ওপাড়ে পুরো অন্য আরেকটা জগৎ যেন। তখন পুজো সবে শেষ হয়েছে, ত্রয়োদশী ছিল বোধহয়। আকাশটা মিঠি আঁকার স্কুলে যেমন শিখেছে , পুরো সেরকম ছিল, ওপরে vermilion আর নিচে chrome yellow. মিঠি সোৎসাহে রানাকে রঙগুলো চেনাচ্ছিল। রানার যদিও সেরম একটা আগ্রহ নেই। ওপাড়ে নামতেই , দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের বন… হাত কেটে গেছিল মিঠির কাশের ধারালো ঘাসে , রানা সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখে পুরে নিয়েছিল ওর আঙুলটা, মিঠির মনে আছে। আর তার মাঝে ছিল একটা বড় শিরিষ গাছ। তার তলায় রানা মিঠিকে একটা কাঁচের গ্লোব মতন জিনিস দিয়েছিল, তার ভেতরে জলের মধ্যে চিকচিকি, একজোড়া সাহেব মেম, বলডান্স করছে।

“ মিঠি এটা তোর জন্য। রথের মেলা থেকে কিনেছি। ’’ রানা বেশ গর্বের সাথে বলে, “ নিজের টাকায়।’’

“ওমা, কি সুন্দর রে!’’ মিঠির খুব সুন্দর একটা মিউজিক বক্স আছে, খুললে মিউজিক বাজে, আর বলডান্স করে দুজন, ছোটমামা দিয়েছে দিল্লি থেকে। কিন্তু এটা যেন আরও সুন্দর তার চেয়েও। সস্তার গোলাপি রিবনে মোড়া , কিন্তু কি সুন্দর একটা আভা বেরোচ্ছে যেন ওটা থেকে।

মিঠি ফস করে কি মনে হয়, রানার গালে একটা চুমু খেয়ে বসে।

রানা চমকে ওঠে।   মিঠি খিলখিল করে হেসে ওঠে।

“রানা জানিস এরা দুজন কি করছে? ’’ মিঠি খোঁচায় ।

“কি আবার? নাচ! ’’ রানা মুখ নামিয়ে আঁকিবুঁকি কাটে মাটিতে।

“ উঁহু, এটাকে বলে বলডান্স। শিখবি? ’’

“ তুই জানিস? ’’ বিস্ময়ে হা করে তাকায় রানা।

“ হ্যাঁ তো, অ্যানুয়াল ফাংশানে আমি আর অঙ্কুশ পারফর্ম করেছিলাম একটা নাটকে । ’’

“অঙ্কুশ কে? ’’ রানা চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করে।

“ কে আবার?  আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার পাশে বসে সবসময় ক্লাসে। ’’ মিঠি মিষ্টি হেসে বলে।

হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে যায় রানা।

“চল বাড়ি চল। দেরি হলে সবাই খুঁজবে আমাদের।’’ রানা ডোঙাতে উঠে দাঁড়ায়।

মিঠি ঘাবড়ে গিয়ে ওর পিছু পিছু যায়।

পাড়ে ফিরতে না ফিরতেই দূর থেকে বাবা মা আর রানার বাবা দিনুকাকুকে চোখে পড়ে । সবার মুখে আষাঢ়ে মেঘ।

দিনুকাকু রানাকে সেদিন মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। বাবা মায়ের “কতবার বারণ করব এখন বড় হয়েছ, যার তার সাথে যেখানে খুশি যাবে না… কলি, ঋত্বিক, সুহানা ওদের সাথে মেশো , আর কত বন্ধু চাই?…’’ শুনে কান্না পায়নি ওর, মিঠির কান্না পেয়েছিল রানা একবারও মুখ ঘুরে তাকালো না বলে।

 

“কাকিমা? ভালো আছ ? ’’ মাধ্যমিকে কলকাতায় টপার মিতালি উঁকি মারে ঘরের ভিতর।

“কে? ওমা, আমাদের মিঠিরানি? কবে এলি মা? ’’ রানার মা ছুটে আসে দেখতে পেয়ে। ছেঁড়া শাড়িতে  তিন জায়গায় তাপ্পি।

“আজকেই।’’

“ আয় মা বোস। তুই কত ভালো রেজাল করলি রে, টিভিতে দেখালো। সবাই দেখলাম গ্রামের লোক মিলে, নে মা মোয়া খা। ’’ কাকিমা মোয়া ধরিয়ে দিল মিঠির হাতে একটা।

“রানা কই? ’’

“রানা তো একন ওর বাবার সাথে টাউনে যায়, ওই হাতে হাতে জোগাড়ের কাজ করে দেয়। ’’ রানার বাবা দিনমজুর। “ এই তো ফিরবে আরেকটু পরেই, বোস। ’’

“না কাকিমা আজ আসি, পরে আবার আসব। ’’ মিঠি উঠে পড়ে।

 

সেবার আর যাওয়া হয়নি রানার বাড়ি। কিন্তু দেখা হয়েছিল রানার সাথে। একদিন খুব সকালে, কাকডাকা ভোরে। রানার  “ কেমন আছিস? খুব ভালো রেজাল্ট করলি তো”-র ফাঁকে দুফোঁটা চোখের জল মিশে ছিল, মুছিয়ে দিতে সাহস হয়নি মিঠির।

 

তারপর দাদু চলে যাওয়ার পর গিয়েছিল দেশে। বিষণ্ণ এককোণে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন হেসেছিল ওর দিকে তাকিয়ে। তাল কেটে গিয়েছিল সঞ্জয় ফোন করাতে। মিঠির বয়ফ্রেন্ড।

আর তারপর শেষ যাওয়া সঞ্জয়ের সাথে বিয়ের একমাস আগে। আইবুড়োভাত খাইয়েছিল কাকু-কাকিমা। কোন দিনমজুরের ছেলের খোঁজ পড়েনি আর।

 

 

কাল রাতে আবার মিতালির গায়ে হাত তুলেছে সঞ্জয়। এই নিয়ে ৪-৫ মাস হল চলছে। রেগুলার। ওর ফোনে আপত্তিকর মেসেজগুলো দেখেছিল ঠিক ৩ মাস আগে, সন্দেহ যদিও আগের থেকেই ছিল। confront করলেই সেটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেত। অতবড় রাক্ষুসে লোকটার সাথে পেরে উঠবে কি করে মিঠি?

বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলে জোর করে মিলিত হওয়ার চেষ্টা। সঞ্জয়টাকে আর মানুষ বলে মনে হয় না মিতালির।  এত ছোট একটা মেয়ে থাকতেও যার আরেকজনের সাথে সম্পর্ক , তাকে আর…

 

কিন্তু সেদিন লিমিট ক্রস করে গেল সঞ্জয় , মেয়ের সামনেই মিতালির গায়ে হাত তুলল । মেয়েটা পুরো দিনটা ভয়ে কান্নাকাটি , ঘর থেকেই বেরোতে চাইছিল না।  মিতালি অনেক সহ্য করেছিল, মেয়ে বড় হোক আরেকটু, কিন্তু এরপর আর মনে হয় দেরি করাটা সমীচীন নয়।

সেদিন দুপুরে মেয়েকে কোলে নিয়ে জানলার ধারে ঠায় বসে ছিল মিতালি।

“মামমাম , তুমি কি দুষ্টুমি করেছ? তাহলে বাবান তোমাকে মারল কেন? ’’

“হ্যাঁ তিতির, আমি খুব একটা বড় দুষ্টুমি করেছি, তাই বাবান খুব বকে দিয়েছে আমাকে।’’

“এমা, মামমাম দুষ্টু , মামমাম আমার থেকেও দুষ্টু।’’

মিতালি চুপ হয়ে থাকে । তিতির বকবক করতে করতে ওটা কি পাখি, ওটা কি ট্রি তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অচিরেই। সত্যিই তো , মামমাম কি কোনদিন তাকে কোলে করে বসে আর জানলা দিয়ে পাখি গুনেছে?

“ ওটা নিমগাছ তিতির , ওই যে খুব তেতো হয়, তোমাকে একবার খেতে হয়েছিল যখন তোমার পেটব্যাথা হয়েছিল, মনে আছে? ’’

“ ইয়াক, ওটা খুব বাজে। মামমাম দ্যাখো ক্রো টা ওই ফ্রুটটা খেতে যাচ্ছে, কি বোকা কাক টা। এই কাক যা যা, শুঃ ! ’’

মিতালি চমকে ওঠে। নিমফল! না রে পাগলি , তেতো নয় রে, তেতো নয়।

 

 

চশমার ঝাপসা কাঁচের আড়ালে দুজোড়া উজ্জ্বল চোখ নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মিতালি। মেয়েকে কোলে নিয়ে।  IRCTC-র সাইট । অনলাইন টিকেট বুকিংটা সেরে ফেলতে হবে, সেই স্বপ্নের দেশটার।

 

যেখানে নিমফল আর পারথেনিয়াম আর কলমির গন্ধে সুখের স্বপ্ন দেখা যায়। যেখানে দিনমজুরের ছেলে রাজা আর মিঠিরানি ঘর বাঁধে শাল-শিরিষের ছায়ায়।

472

 

 

 


2 Comments

 মিমিক্রি

লাস্ট কয়েকদিন ধরে সপ্তাহান্তের মধ্যবিত্ত বাজারের থলির মতো অনেক এলোমেলো চিন্তা আর স্মৃতি যেন উপচে পড়ছে। কিছু একটা অজানা insecurity তে সবসময় ভুগতো নদী, সুযোগ পেলেই শুধু সাম্য কে ফোন। দিনে ৪-৫ বার, বেরে সেটা প্রায় ২০-২১ ভার হয়ে গেছিল। সাম্য রেগে যেত, যে কারো রেগে যাওয়া স্বাভাবিক, অফিসে জরুরি মিটিং চলছে, তখন ফোন। বাড়িতে কাকু এসেছেন দু-বছর বাদে, তখন ফোনে কথা বলতে হবে। কিংবা রাস্তা ক্রস করছে, তখন মোবাইলে টুংটাং।

“তোর কাউন্সেলিং করানো উচিত নদী। ’’

প্রথমে শুনে রেগে গিয়েছিল ও।

“ওহ! আমি তোর বেশি খোঁজ রাখতে চাই বলে এরকম বলবি? মা-র একসময় একটু প্রবলেম হয়েছিল বলে আমিও পাগল? তোর এক্স অনেক ভালো ছিল আমার চেয়ে বল? Cheating behind your back!! সেটা অনেক ভালো, না?.. ’’ নিজের গলাটা যে কখন পাবলিক বাসে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বুঝতে পারেনি।

“শান্ত হ । Calm down নদী। ’’  ঠাণ্ডা দৃঢ় গলায় বলে সাম্য।

চমকে ওঠে নদী। “আমি তো এরকম ছিলাম না। ’’ অস্ফুটে বলে ।

সেই শুরু, গত ৩ মাস ধরে এটাই রুটিন মোটামুটি ওদের। কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। বেশ কয়েকবার অনেক কিছু বলে ফোন কেটে দিয়েছে সাম্যর মুখের ওপর ।সাম্যর চেয়ে বেটার কেউ ওকে চেনে না। খানিক পরে আবার নিজেই ঝরঝর করে কান্না।

প্রশ্নটা যে compatibility –র নয়, বুঝিয়েছে ওকে সাম্য।

পেপার টাও accepted হয়নি নদীর। এত বড় একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার, কত আশা ছিল এতদিনের। ভীষণ খেটেছিল পেপারটা নিয়ে । বোঝাল অনেক কাল রাতে সাম্য।

এলোমেলো লাগছিল। বড্ড কান্না পাচ্ছে। ডাঃ দাসগুপ্তা বলেছেন রেগুলার ৮ ঘণ্টা ঘুমোতে। ঘুম হয়না এমনিতে নদীর।

“আমার রাত জাগা তারা, তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি……” বেজে ওঠে ফোন।

“হ্যালো , সাম্য? ’’ জড়ানো গলায় বলে নদী। খুব ঘুম পায় আলজোলামে।

“সাম্য… কে?”

“কে?” উঠে বসে নদী, ডাইনিং স্পেস থেকে ৩টে ঘণ্টার সুরেলা আবর্ত কে কেটে দিয়ে কোথায় একটা বেসুরো রাতচরা পাখি ডেকে ওঠে।

“ইকবাল বলছি, ভালো আছো? ’’

বিস্ফারিত ভাবে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটে নদী।

“হ্যালো? ’’ ওপ্রান্তে প্রশ্ন।

“হু? আছি। আমি ভালো আছি। তুমি? ’’ সম্বিত ফেরে নদীর।

“আছি, বেশ আছি একরকম। ’’ ইকবালের গলাটা এত গম্ভীর ছিল আগে?

“ ফারিয়া ? ’’ বলেই সামলে গেল নদী।

“তুমি জানো ওর নাম? আছে, ভালোই আছে। ’’ ইকবাল এতটা মার্জিত ছিল আগে?

“ জানি। ’’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে এপারে, অজান্তেই।

“হুম।’’

দু প্রান্তই চুপ।

“কি করছ এখন? ’’ নিস্তব্ধতা ভেঙে অল্প জল ছলকে ওঠে নদীতে।

“নেট ক্লিয়ার করেছি এই মাসেই, ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পড়বে এবার। ’’  ডাক পড়বে? এতটা কাব্যিক ছিল ইকবাল? ফারিয়া খুব ভালো রেখেছে।

“বাহ! কনগ্র্যাটস! ’’

“থ্যাংকস।’’

ক্যালেন্ডারে হিমবাহর ছবি, বরফনদী। পাশে বাবা লাল কালি দিয়ে এমাসের ভর্তুকির গ্যাস সিলিন্ডার দেওয়ার তারিখ টা লিখে রেখেছে।

“নদী?’’

“বলো।’’

“ পড়াশুনো কেমন চলছে? বাড়িতে এখন সব ওকে? ’’

চোখটা জ্বলছে খুব।

“কেন ফোন করেছ ইকবাল?’’

“ এমনি, কেমন আছো জানার জন্য।’’ ইকবাল ২ সেকেন্ড থেমে উত্তর দেয়।

“ সত্যি বলো ইকবাল।’’ উফ! এই কাঠখোট্টা সাম্যটার সাথে থেকে থেকে না বড় ঠোঁটকাটা হয়ে গেছে নদী। ইশ, কি ভাববে এবার?

“ উমম…মানে আসলে, তুমি সত্যি ভালো আছো নদী?’’ এতক্ষণে পুরনো এক টুকরো ছবি যেন উঁকি মারল নদীর মনে।

“আছি ইকবাল।’’

“ বয়ফ্রেন্ড?”

“ও ভালো আছে। খুব ভালো রেখেছে আমাকে। ভীষণ ভালো আছি আমি সাম্যর সাথে । ’’

“ও, যাক ভালো। ’’

“ ওকে”

“বাড়িতে জানে, দুজনেরই। আর আমার বাড়িতে সবাই ভাল আছে। সাম্যর জন্য।’’ নদী বয়ে চলে।

“গুড” এপার থেকেও যেন ইকবালের সেই শান্ত স্তিমিত হাসি টা দেখতে পায় নদী।

“নাইট” থেমে যোগ করে ইকবাল।

অস্ফুটে একটা “এখনও” বেরিয়ে আসে , নদী ফোনটা কেটে দেয়।

 

“নদী?”

“এটা কার নাম্বার, ইকবাল?’’

“আমার, নতুন। ’’

“ ও আসলে আগেরটা আমার মুখস্থ ছিল ……আছে” অস্ফুটে যোগ হয়।

“ আজ আবার ফোন করলে? ’’

“ ইচ্ছে হল, বড্ড। ’’ এটা অচেনা শব্দ, ইকবালের মুখে।

“ ইকবাল? ফারিয়ার সাথে সব ওকে তো? ’’ নদী হালকা আগ্রহ দেখায়।

“ হ্যাঁ , একদম। আই অ্যাম রিয়েলি হ্যাপি। ’’ ইকবাল অনেক বদলে গেছে। এত উৎফুল্ল , এত আবেগ কোনদিন তো! কি জানি ওই মেয়েটা কি দিয়েছে এমন। শরীর? যেই শরীরের ওপর একদিন পাগলের মত মোহ ছিল ইকবালের, কিছুই কি কোনদিন…? ছি, কিসব ভাবছে ও।

“ ইকবাল, আমি রাখছি, এই নিয়ে ৩দিন হল আজ, আমার ঘুমনো দরকার রাতে, ডক্টর বলেছেন। আমি ঘুমুচ্ছিনা জানলে সাম্য ভীষণ রেগে যাবে। ’’ নদী গম্ভীর গলায় জানান দেয়।

“সাম্য, সাম্য তোমাকে বকে না, খুব? ’’

“মোটেও না । আর এমনিতেও  দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস। ’’ নদীর সত্যি রাগ হচ্ছে এবার।

“ ওকে, তাহলে বাই। ’’ ওপারে একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস।

“ইকবাল, কেন? কেন? কেন করলে ওরকম? ’’ নদীর বাঁধ ভাঙল । ডান চোখটা খুব জ্বলে কাঁদলে আজকাল, কতদিন কাঁদেনি বল তো?

“তুমি কারণটা জানো, নদী। মেনে নিত না আম্মু বা আব্বা কেউই। ’’ ঠাণ্ডা গলায় উত্তর আসে।

“আম্মু?!” নদী কেমন চমকে ওঠে । ইকবাল মা বলতো তো, ওর আম্মুকে! এই নিয়ে কথাও হয়েছে ওদের সেই একদিন। কি জানি, ওটাও হয়তো একটা অভিনয় ছিল। পুরো সম্পর্কটার মতনই।

গুড নাইট ইকবাল।

“ বাই নদী। ’’

পিইইক করে ফোনটা কেটে যাওয়ার আওয়াজে কেঁপে ওঠে কেমন নদী।

 

আরও ২৪ ঘণ্টার অপেক্ষা। আবার নিশ্চয়ই আসবে ফোন। নিশ্চয়ই। ইকবাল আবার আমাকে ভুলতে পারছে না। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে সারাদিন নদী। স্মৃতির ঘোর। সাম্যর ফোন খেয়ালই করেনি দুবার। ইকবাল। সেই ইকবাল।

সেই প্রথম ভিক্টোরিয়া, প্রথম চুমু, প্রথম আদর, প্রিন্সেপ ঘাট, প্রথম প্রেমের ইকবাল।

 

এগারোটায় সাম্য ফোন করেছিল, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড় , একদম রাত জাগবি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। “ আই লাভ ইউ নদী ’’-র উত্তরে আজ প্রথমবার “বাই সাম্য” ভেসে এলো।

সাম্য। অসাধারণ একটা ছেলে, সবদিক থেকে। বলে শেষ করা যাবেনা ওর গুণের লিস্টি। এখন চাকরি করে আইটি তে, কিন্ত একসময় নাট্যজগতের রীতিমত দাপুটে অভিনেতা ছিল। এখন অনিয়মিত হয়ে গেছে থিয়েটার। আর লেখকও  বটে সেই লেভেলের। এই এটুকু বয়েসেই কতকিছু অ্যাচিভ করেছে। লেখার থেকেই তো সব শুরু ওদের। নদী স্মিত হাসে। আর নদীর সবচেয়ে পছন্দের গুণ, সাম্যর দুর্দান্ত ভয়েস মিমিক্রি করার ক্ষমতা। এমন হুবহু নকল করে এক একজনের গলা, অমিতাভের টা তো পুরোপুরি । এমনিতে গলাটা মিহি, কিন্তু ফলস ব্যারিটোন টা সেরা করে কিন্তু সাম্য। গানটাও ভালো গায়, একটা মাঝারি বাজেটের বাংলা আর্ট ফিল্মে , পরিচালক ওর বন্ধুস্থানীয় ,একবার একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিল, অনেকদিন বিগ বি তকমা পিছু ছাড়েনি। নদী হাসে, আপনমনে ।

“ওগো নদী আপনবেগে পাগলপারা …’’ মাতলার তীরে সাম্য শুনিয়েছিল ওকে।

কত ভাল সাম্য। কোন তুলনা হয় ওই স্বার্থপর , সমাজভীরু, শরীরসর্বস্ব  ছেলেটার সাথে। তবু কেন পিঠের পুরনো ক্ষতটার মতো ইকবাল থেকে এখনও রক্তক্ষরণ হয়?

১ টা।

২টো ।

৩ টে।

ঘুম নেই নদীর চোখে আজ। ওষুধ খায়নি আজও, কালকের মতই।

কিন্তু ফোন এলো না তো? ৩ টে তো বাজে! ইকবাল তবে আর করবে না? ইস, কেন যে বলতে গেল ওভাবে ? শুধুই তো বন্ধুত্ব এখন ওদের মধ্যে, ইস, সেটাও নষ্ট করল, জেনেবুঝে।

আবার সেই অবিন্যস্ত ভাবটা গ্রাস করছিল নদীকে। কি করবে? বালিশে মুখ গুঁজে আবার সেই ভাঙা চিৎকার। আবার সেই শ্বাসকষ্ট , ইনহেলার। সাম্যকে কল করবে? করল , দুবার রিং হতেই কেটে দিল। না আজকে নয়। আজকে আবার নদী পুরনো ফ্রেম গুলোকে জীবন্ত করে তুলবেই একটা একটা করে ছুঁয়ে । সাম্যর অধিকার নেই সেখানে।

৩-৩৫। মোবাইলের আলোয় চোখে খানিক ধাঁধাঁ লাগে নদীর, অন্ধকারে। টেবিলল্যাম্প টা জ্বেলে ড্রয়ার হাতড়ায়ে, খেয়েই নেব অ্যালজোলাম, মানে হয়না এসব অতীতকে প্রশ্রয় দেওয়ার, এক্ মুহূর্তের জন্য মনে হয় লুকিয়ে কেনা Marlboro-র প্যাকেটটা পাওয়া অবধি। সাম্য প্রমিস করিয়ে ছাড়িয়েছিল নেশা টা।

একটার পর একটা। অনেকদিন বাদে আজ “নদী আপনবেগে পাগলপারা” … জল শুকিয়ে গাল গুলো কেমন চিটচিট করছে।

আর নয়।

মোবাইলটা কাছে টেনে নিয়ে নদী আগের রাতের কললিস্ট ঘাটে।

 

“নদী? তুমি?’’ ঈষৎ জড়ানো আর চমকে যাওয়া গলায় ইকবাল বলে।

“আজ ফোন করনি কেন ইকবাল? ’’

“মানে, আর কি, তুমি কাল ওরকম বললে…”

নদী ইকবালের কথা কেড়ে নিয়ে বলতে থাকে “তো? তার মানেই সেটা সত্যি? তুমি সত্যি একটুও কি কোনদিন বুঝেছিলে আমাকে ইকবাল? একটুও? ’’

নিস্তব্ধতার একটা অদ্ভুত দোষ আছে, পিন, ঘড়ি নয়, নিজের অবিশ্বাস্য হৃদস্পন্দনেরও জানান দিয়ে দেয়।

“কি চাও ইকবাল? সত্যি করে বলো! ’’

“নদী, সত্যিটা শুনবে?

“বল”

“ তোমাকে চাই, তোমার শরীরটাকে শুধু। চাই, আরেকবার, বারবার। আমি ভুলতে পারছিনা ওগুলো শুধু । এখনও তোমার ওই ছবিগুলো; ছবিগুলো নিয়ে আমি fantasize করি…’’

“ কাল বিকেল ৪টে, প্রিন্সেপ ঘাটের সেই জায়গাটার সামনে। ’’ দৃঢ় গলায় বলে নদী কেটে দেয় ফোনটা।

এবার ঘুমোবে ও। ওষুধ ছাড়াই।

 

নীল সালওয়ার কামিজটা, ওদের, ওর আর ইকবালের প্রথম দেখা হওয়ার দিনের…আর একটা ছোট ব্যাগ হাতে।  নদী ঘড়ির দিকে তাকায় বারবার হাঁটতে হাঁটতে।

 

ইকবাল কোনদিন তো লেট করত না। ভীষণ স্বভাববিরুদ্ধ এটা ওর। আজ আসবেই ও, নদী জানে। সেই কবে যেন? কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন লাস্ট দেখা হয়েছিল। তারপর দূর থেকে যতবারই দেখেছে, ইকবাল সরে গেছে আড়ালে।

সারাদিন সাম্যর ফোন ধরেনি নদী। আজকের দিনটা শুধু ওর, নিজের।

 

“সাম্য?! তুমি? এখানে কি করছ? ” নদী দূর থেকেই চিৎকার করল, চেনা অবয়বটা unexpected জায়গাটায় দেখতে পেয়ে ।

“এই জায়গাটায়? মানে? তুমি ?!কি হচ্ছে টা কি এসব?”

সাম্য কি কাঁদছে? চশমার পেছনে চোখ পুরো ঘোলাটে। “নদী, ভাবিনি এরকমটা করবি শেষে!’’ সাম্যর গলা ধরে আসে।

কি করে জানলো এসব কিছু মাথায় নেই আর নদীর। সাম্য? ওর সাম্য ? কাঁদছে? আজ ওর জন্য?

“সাম্য!! শোনো আমার কথাটা প্লিজ হিয়ার মি আউট ফার্স্ট।’’ নদীও আজ উথালপাথাল।

ঢেউ গুনছে একটা কাপল, অদূরেই ।

“নদী, আমার বোঝার আর কিছু নেই রে, একটা ছোট্ট টেস্ট করেছিলুম জাস্ট , ভেবেছিলুম তুই পাশ করবি, তাই করেওছিলিস, কেন ফোন করলি আবার কাল রাত্রে? কেন? ছি নদী! পারলি তুই কি করে এটা?

“টেস্ট? মানে?’’ নদী কেমন আনমন   হয়ে যায়।

“ইকবাল নয়, ফোনগুলো আমি করতাম। তোর ফোনে একবার ইকবালের কয়েকটা whatsapp record পেয়েছিলাম, তুই ভুলেই ডিলিট করিসনি জানি। ওটা থেকে গলাটা রপ্ত করে… তুই ওষুধের ঘোরে অত বুঝিসনি …কিন্তু নদী তুই এটা? ……”

 

“কী??? সাম্য? তুমি? ’’ ঝড়ের আগের মুহূর্তের থমথমে স্তব্ধতার মধ্যে নদী ব্যাগ থেকে ২ টো ছিঁড়ে টুকরো করা চিঠি, আর আধপোড়া বেশ কয়েকটা ছোট জিনিস বের করে করে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে সাম্যর পায়ের দিকে। শেষে একমুঠো ছাই বের করে হাওয়ায় ভাসতে দেয়।

“ইকবালের মুখের ওপর এগুলো ছুঁড়ে দিতে এসেছিলাম সাম্য। আর ওর এই অনেকদিনের প্রাপ্যটা। ”

একটা সপাটে চড় এসে পড়ে সাম্যর গালে। নদী হাঁপাচ্ছে ।

“নদী আর ইউ ওকে?’’ সাম্য শকটা সামলে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

“আই উইল বি। ”

দাঁতে দাঁত চেপে সাম্যর দিকে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে নদী। আজ অনেক ওষুধ খাওয়ার আছে। অনেক।