“ধুর , তোর কাজকর্ম নেই নাকি শালা আলবাল হ্যাজাচ্ছিস বসে বসে? দোতলার ফিজিক্সের স্টাফরুমে ৫ টা কফি দিয়ে আয়। ’’ তপনদা বহুদিন আছে এই কলেজে। ক্যান্টিনটার সর্বেসর্বা মানে সবাই ওকে। ওর ওপরে কথা বলার সাহস নেই শীর্ষেন্দুর। সে নতুন জয়েন করেছে।
সব পিতৃস্থানীয় কলিগদের মধ্যে একমাত্র খানিকটা সমবয়সী বিরজু। ওড়িশার ছেলে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলে। ওর সাথে কথা বলে সুখ নেই। আর বাকিদের সাথে বাজারদর বা কলেজের নতুন ব্যাচের ডবকা মেয়েদের নিয়ে আলোচনায় ওর কোন ভূমিকা থাকতে পারে বলে ভাবেওনি শীর্ষেন্দু। তবু আজকে একটা বর্ণনা শুনে এগিয়ে গিয়ে একটু ঔৎসুক্য প্রকাশ করতে গেছিল , এই ঝাড় জুটল।
মনটা তেতো হয়ে গেল। ট্রে টা হাতে তুলে নিয়েও বেরোতে ইচ্ছে করছিল না, কারণ জানে এখন ওই বর্ণনাকে কিভাবে কুৎসিত অশ্লীলতার চটকদার মোড়কে ভরে পরিবেশন করা হবে। সবাই দেঁতো হাসি হাসবে; বিরজুও। এইসময়ে ও বাংলা বুঝতে একটুও ঠোকর খাবে না। শরীরটা এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে ছটফট করতে লাগলো শীর্ষেন্দুর।
কারখানার মেশিনে ডানহাত কাটা, ছাঁটাই হওয়া একটা পঙ্গু বাবা, রংচটা চুড়িদারের ক্লাস টেনের একটা বোন, আর দর্জির দোকানের ফাইফরমাশে বিধ্বস্ত একটা মা। বাড়িভাড়া আর ঋণশোধের জিজ্ঞাসাচিহ্নময় নোনা ধরা দেওয়ালে তেলচিটে লক্ষ্মীপটের গায়ে অভিমানের ধুলো; ধুলোতে মায়ের মাঝরাতের কাশি যখন ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে রেসোনান্ট হয়ে যায়, ওষুধ আর জলটা এগিয়ে দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়তে এখন আর অসুবিধে হয়না শীর্ষেন্দুর।
লাউশাক , চারাপোনার সংসারে কবিতা লেখা যে চলে না বুঝতে সময় লাগেনি সদ্য উচমাধ্যমিকের গণ্ডি ডিঙ্গনো শীর্ষর।ছুঁচ-সুতো-কামিজের মাপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন মায়ের হাতে বালতি – ঝাড়ু ধরিয়ে দেওয়া হল, তার কদিন পরে শীর্ষেন্দু এই ক্যান্টিনটায় ঢুকল । সকালে কলেজ যাচ্ছি বলে বেরনোর সময়ে মনের সামনে ইংলিশ অনার্সের অ্যাডমিশনের লিস্টটা বিদ্রুপ করে। সকালে ক্যান্টিন, বিকেল থেকে রাত অবধি টিউশনি , বোনকে নিয়ে বাড়ি ফেরা।
নন্দিতাকে ভালো লাগত। একবার সাহস করে একটা কবিতামাখা চিঠিও পৌঁছেছিল গোলাপিরঙা তেতলা বাড়ির কোনের ঘরটায়। সেটার আর হদিশ বা প্রত্যুত্তর কোনটাই পাওয়া যায়নি।বাবার অ্যাকসিডেন্টটার খবরটা আসার পর “একদিন দেখিয়ে দেব বড় চাকরি করে” গুলো অচিনপুরের মর্গে ফ্যাকাশে হয়ে শুয়ে থাকল, কড়িকাঠের দিকে নির্বাক অচলদৃষ্টে।
খালি ট্রে টা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামার সময়ে ঘটলো ব্যাপারটা। বাঁক ঘুরতেই সোজা মুখোমুখি। কাল একটা নীল টপ ছিল, সামনের প্রজাপতিটায় টম্যাটো সস লেগে গেছিল, কুঞ্চিত ভ্রু শীর্ষেন্দুর কাছে টিস্যু চেয়েছিল, আরেক হাতে ধরা ছিল “ফার ফ্রম দা ম্যাডিং ক্রাউড” । আজ একটা বেগুনি কুর্তি, তবে চুলটা খোলা, দুদ্দারিয়ে উপরে উঠছিল, তখনই এই কাণ্ড।
ভেবলে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রাগ হতে গিয়েও হেসে ফেলল মেয়েটা। তড়াক করে সরে যেতে গিয়ে শীর্ষেন্দুর “এক্সকিউজ মি”-র প্রতীক্ষা করা কানে একটা অচেনা শব্দযুগল প্রবিষ্ট হল।
“লাগেনি তো?’’
রবি ঠাকুরের গল্পে পড়েছিল “কর্ণ দিয়া মরমে পশিল গো” ব্যাপারটা।
আজ রাতে ঘুম নেই শীর্ষেন্দুর চোখে ।
মা অনেকক্ষণ ধরে কাশছে, তবে সেটা কারণ নয়। সারাদিনের ক্লান্তি , তবু কিছুতেই ঘুম আসছে না। পুরনো ক্যাম্বিস খাট টায় এদিক ওদিক করতে গেলেই মৃত্যুযাত্রীর শেষ আর্তনাদের মতো শোনায়। বিরক্ত হয়ে উঠে বেড়ালপায়ে হেঁটে দরজাটা খুলে বাইরে বেরোয় শীর্ষেন্দু ।
মায়ের একসময়ের শখের একটেরে বাগানের কঙ্কালটুকু পড়ে আছে। ভাঙা টবের দেহাবশেষের মাঝে একটুকরো স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ালো ও। বা হাতের চেটো দিয়ে চোখটা আলতো করে রগড়ে নিতে নিতে শীর্ষেন্দু দেখল ওর না ফোটা রেশমগুটি গুলো ধীরে ধীরে নীল বরফে ঢেকে যাচ্ছে, নীল আকাশে ওড়া বেগুনি প্রজাপতি হওয়ার আগেই।
বোনের গায়ে ছেঁড়া রঙের স্নেহমাখা অনাভিজাত্য হালকা করে টেনে দিয়ে বিনা দীর্ঘশ্বাসে ঘুমিয়ে পড়ল শীর্ষেন্দু।
তিন মাস হল এই ক্যান্টিনে। মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল অক্টোবরের এক একেঘেয়ে সকালে। ছুটি পড়ার আগের দিন। অর্ধেক কলেজের ইন্টারনালের শেষ দিন। চা আর কফির ডিমান্ড সবচেয়ে বেশি হয় এসব দিনে। সকলেরই চেহারায় খুশি মেশানো স্ট্রেস। এর মধ্যে শীর্ষেন্দু দেখতে পেল একটা প্রজাপতি উড়ে উড়ে এলো, ছটফটে চুলে বেমানান ঋতুর গন্ধ। এসে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস বলল, শীর্ষেন্দু বিভ্রান্তের মত এগিয়ে দিল। মেয়েটা মিষ্টি হেসে “থ্যাংকস” জানিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশে গেল।
সেদিন থেকে শুরু। সারা পুজোর ছুটি শীর্ষেন্দু গোলাপি-নীল একটা ঘোরের মধ্যে কাটাল। একটা টিউশনি গেল, ছেলেটা সেবারও ক্লাস ৮ এর ষাণ্মাসিকে বাংলায় ফেল করল বলে। নতুন পাওয়া চাকরি আর টিউশানির টাকা জমিয়ে মা-র একটা ছাপাশাড়ি , বোনের কিছু সহায়িকা বইয়ের পরেও যেটুকু বেঁচে ছিল, সেই দিয়ে একদিন কফিহাউসে কফি খেল, পাইরেটেড দুটো ইংরেজি গল্পবই কিনল, আর কলেজ স্কোয়ারের বিক্ষিপ্ত প্যান্ডেলের আড়ালে বসে থাকা যুগলদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তারপর দিন রাতে মোমবাতি জ্বেলে ফের খুলল একটা হালকা হলদে পাতার লাল ডায়েরি। লিপিবদ্ধ হল ছড়িয়ে থাকা কথারা। একযুগ পর। তারপরের দিনও। তারপরের দিনও।
ঠিক ২৭ দিন ১১ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড বাদে ফের ঝড়ের আগের সন্ধ্যাতারার দেখা পেল শীর্ষেন্দু। কলেজ খোলার পর প্রথম দুদিন আসেনি। তারপর এল; একদল বন্ধুর সাথে খিলখিলিয়ে। উৎসুক হয়ে বসেছিল শীর্ষেন্দু, একটা কোল্ড ড্রিংকস এগিয়ে দেবে বলে, কিন্তু সেদিন আর আসল না সে নিজে। আরেকজন কে পাঠালো তার খাবারটা নিয়ে যেতে।
তারপর আবার কদিন দেখা নেই। যেদিন এলো ৩ মিনিটের জন্য, সেদিন শীর্ষেন্দু বোকার মত মজে ছিল কোহলির ইনসাইড আউটে। গলার আওয়াজ শুনে যখন চমকে ফিরল, ততক্ষণে সে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বাচ্চা ছেলের পাড়ার ক্রিকেটে ব্যাট না পাওয়ার ঠোঁটফোলানো অভিমান নিয়ে সারদিন গুম হয়ে থাকল ও।
ক্লাস ৫ এর পুচকে একটা মেয়ে, ও বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস , ভূগোল পড়ায়। রোজকার মত মেয়েটার দাদু দরজা খুলল, মুখ আজ থমথমে। মাথা ঘামালো না শীর্ষেন্দু বিশেষ। ভেতরে ঢুকে দেখল মেয়ের বাবা, মা সকলে টেবিল জুড়ে আষাঢ়ে মেঘ হয়ে বসে। মেয়ে ধারেকাছে নেই।
“বোসো।’’ মেয়ের মা কড়া গলায় নির্দেশ দিল।
খানিকক্ষণ সবাই চুপ, শীর্ষেন্দু আঁচ টা পেয়েও পাচ্ছে না যেন।
“ এই ছেলে তুমি আসলে কি করো খুলে বল তো?” দাদু আর সামলাতে পারলেন না।
“আহ বাবা, আপনি চুপ করুন।’’ মেয়ের মা ধমকে থামিয়ে দেয়।
“শোনো, তুমি কোন কলেজে পড়ো যেন বলেছিলে?
“ চারুচন্দ্র কলেজ, ইংলিশ অনার্স।’’ আমতা আমতা করে বলে শীর্ষেন্দু।
“ কই প্রমাণ দেখাও, আইডি কার্ড কোথায়? ’’
“এখন তো সঙ্গে নেই। ’’ বেশ ঘাড় উঁচু করেই বলে ও।
“ বেরিয়ে যাও এক্ষুনি। একটা কলেজের ক্যান্টিনে কাজ করা ছেলে আমার নাতনিকে পড়াবে? তাও আবার মিথ্যে পরিচয় দিয়ে? দাদুর কথাগুলোর নীরব সায় দেয় গোটা ঘরটা। মাথা হেঁট করে ঝাপসা চোখে বেরিয়ে যায় শীর্ষেন্দু। টুকরো টুকরো কথা তখনও এসে বিঁধছে তীক্ষ্ণ বরফকুচির মত।
“ভাগ্যিস সেদিন নীল এসে ছবিটা দেখে বলল”
“হ্যাঁ, তোমার মেয়ে তো আবার এইরকম একটা ছেলেকে ফেভারিট টিচার বলে নোটবুকে তার ছবি লাগিয়েছে।“
“কিরকম ডেস্পারেট ভাবতে পারছ? এতদিন এভাবে মিথ্যে বলে চালিয়ে দিল?”……
যেমন মায়ের সাথে ৯০ এর দশকের বাংলা সিনেমায় দেখত ছোটবেলায় হা করে, যেমন বড়বেলায় সত্যজিৎ, মৃণাল সেন চিনে হাসত এসব ভেবে, তেমনি একটা কিছু যে বাস্তবেও ঘটতে পারে, এবং তার নিজের সাথেই, ধারণা ছিল না শীর্ষেন্দুর। আজ হঠাৎ ওই অতিরঞ্জিত , ঝাঁঝালো আবেগ আবহপূর্ণ ছায়াছবির বেনামি পরিচালকের প্রতি এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা জেগে উঠল।
“এই দাদা, আবার রাতে ঘুমনো বন্ধ করেছিস না? ইশ চোখগুলো কি লাল হয়ে আছে। কি হয়েছে বল তো তোর? কলেজে কিছু হয়েছে? ওই তপনদা না কে লোকটা, আবার কিছু বলেছে রে? দাদা, ওই দাদা শুনছিস?”
“ উফ চুপ করবি একটু তুই? ভালো করে পড় শুধু, সামনে টেস্ট। বাকি কিছু নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না।’’
দাদার ঝাড় খেয়ে চুপ করে যায় বোন।
আলু-বেগুন-ঝিঙ্গের চচ্চড়ি দিয়ে রুটি টুকরোটা মুখে পুরে রান্নাঘরের কালিঝুল মাখা শিকভাঙ্গা জানলাটা দিয়ে বাইরে তাকাল শীর্ষেন্দু। আচ্ছা, মেয়েটা এখন কি করছে? হয়তো সাদার ওপর লাল ফুটফুট চাদরে উপুড় হয়ে শুয়ে হয়তো উপন্যাস পড়ছে। নীল কুর্তির বেখেয়ালে বেরিয়ে পড়েছে ব্রা এর একটা ফিতে। শুয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে হয়ত উঠে বসল একটু , তারপর পাশে হাত বাড়িয়ে গ্লাসের কোল্ড ড্রিংকে চুমুক দিতে দিতে ফের ডুবে গেল ভিড়ের গভীরে।
“কি রে, খা!” মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরল শীর্ষেন্দুর।
মা একসময়ে অনেক বই পড়ত, বাড়িতে রোজ খবরের কাগজ কিনে আনত বাবা, আর মা-র জন্য কত রংবেরঙের ম্যাগাজিন। মা-ই নাম রেখেছিল শীর্ষেন্দু। প্রিয় লেখকের নামে।
পরদিন কি যে হল হঠাৎ, একবার একঝলক লাঞ্চ ব্রেকের ভিড়ের মাঝে দেখেছিল ওই ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া খোলা চুল, উঁচু করে একটা লম্বা কাঁটা দিয়ে সামলে রাখা। তারপর ভুল বকতে শুরু করল শীর্ষেন্দু, তাও আবার বিরজুর কাছে। বোনের কথা, নন্দিতার কথা সব । তখনই তপনদার ঝাড়টা খেল ।
আর তারপরেই ঘটল সেই ছায়াপথে নীহারিকা ধাক্কা খাওয়ার সময় থেমে যাওয়া ঘটনাটা।
সেদিন রাতে শীর্ষেন্দু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সবকিছু ঝেড়ে ফেলার, ছুঁড়ে ছিঁড়ে ফেলার। তার জীবন অন্য ধাতুতে গড়া হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই, তার মতামত নেওয়ার অপেক্ষা রাখেনি। তাই পরদিন একজন ঝা চকচকে সুপুরুষ ছেলের হাত ধরে যখন সে ক্যান্টিনে ঢুকল, বা যখন তারা এক গ্লাস থেকেই কোল্ড ড্রিংক খেল, শীর্ষেন্দু থরথর করে কাঁপতে গিয়েও কাঁপল না। এই বরফের ঝড় তাকে হারাতে পারবে না, ভরসা আছে।
আর আছে বলেই পরের দিন , তারপরের দিন আর তারপর আরও অনেক অনেক গুলো দিন চোখের সামনে ভোরবেলার এক উত্তাল ঝড়ের ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে হতে বদ্ধ একমুঠো নিঃশ্বাস হয়ে যেতে দেখেও সে চুপ থাকল, নিশ্চল , নির্জীব।
বোন ততদিনে মাধ্যমিক পাশ করেছে। সায়েন্স নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু টিচার নিতে হবে সব সাবজেক্টে। তাই আর্টস।
নতুন স্কুলে যাচ্ছে বোন। সকালে স্টেশনে যাওয়ার পথে বোনকে পৌঁছে দিয়ে যায় স্কুলে; পার্টি অফিসের পাশের মদের ঠেকটার কতগুলো ছেলে বেশ কয়েকদিন উত্যক্ত করেছে ওকে। কারও সাহস নেই গলা বড় করে প্রতিবাদ করবে। পরের বাড়ির মেয়ের হয়ে বলতে গিয়ে কেউই চায় না নিজের অন্দরমহলে বিপদ ডেকে আনতে। শীর্ষেন্দু জানে ওরা পাঁচজন ঘিরে ধরলে ও কিচ্ছু করতে পারবে না। ওর বোনও জানে। তবু একটা ভাসা ভাসা আশা নিয়েই বেঁচে থাকা। সবটা সময়।
মিথ্যে মিথ্যে তাসের ঘর সাজিয়েই তো মানুষ বেঁচে থাকে, যতই সে ভাবুক সে বাস্তবের শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবা বহুদিন ধরেই শয্যাশায়ী। ইদানিং একেবারেই অচল। বেডপ্যান কেনার আগে অবধি মাকেই সব পরিষ্কার করতে হত। ওষুধের খরচ হুহু করে বাড়ছে। এর মধ্যে বাড়িওয়ালা আবার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের চেহারার দিকে তাকানো যায় না। সেদিন রাতেই কাশতে কাশতে রক্ত পড়ল। শীর্ষেন্দুর চোখ ফেটে জল আসে, বোনকে দেখে শিখেছে মুখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ঠায়।
শীর্ষেন্দুও নতুন কাজ নিয়েছে আরেকটা । টিউশন মাত্র দুটো টিকে আছে। তাই কলেজ থেকে শিয়ালদহ হয়ে ফেরার পথে সান্ধ্য খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন কেনে। তারপর ওই দু ঘণ্টা ফেরি। মাঝে মাঝে বেঁচে যাওয়া ম্যাগাজিনগুলো সযত্নে এনে মায়ের বিছানার কোণে রেখে দেয়। মা চোখ বন্ধ করে হাসে ওর দিকে তাকিয়ে।
বাবা হাসপাতালে ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। রোজ মা গিয়ে দেখে আসত, খাইয়ে আসত রান্না করে নিয়ে। শীর্ষেন্দু ৩ দিন গেছিল, আর বোন একদিনই। শেষের দিন ওরা তিনজনেই ছিল, শীর্ষ দেখল মায়ের হাতটা চেপে ধরে বাবার হাত টা ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ল, কিছু একটা বলতে গিয়ে মুখটা থমকে গেল, খানিকক্ষণ বিভ্রান্তির পরে মায়ের বুকফাটানো কান্না।
শীর্ষেন্দু কিন্তু কাঁদল না, বরং কাঁদতে চাইল কিন্তু পারল না। কিছুতেই না। অথচ ও পাথর হয়ে যায়নি, সচল । ও নিজেও অবাক হয়ে গেল , বাবাকে কি অনেকদিন আগেই হারিয়েছিল ও? মনে পড়ে না শেষ কবে বাবার পাশে বসে কথা বলেছে, বাবা টার শীর্ণ হাত ওর মাথায় বুলিয়ে দিয়েছে।
দুদিনের ক্লান্তি আর অবিন্যস্ত চুল, একমুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকল শীর্ষেন্দু। তপনদা বসতে দিল একটা বেঞ্চ টেনে। বিরজু চা-জল এনে দিল। শীর্ষেন্দুর অসহ্য লাগছে এসব। ও কাজ করতে এসেছে, ও জানে একদিনের টাকা কাটা যাওয়ার দাম কিভাবে চোকাতে হয়।
“তপনদা আমাকে কাজ করতে দাও” সংক্ষেপে বলে ও।
“বস না একটু, বুঝি রে তোর কষ্টটা । আমার বুড়ো বাপটাও তো, আজ আছে কাল নেই অবস্থা।’’ তপনদা আলগা আবেগ এনে গলা ভারী করে।
বিরক্ত হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। রোজকার কমলা হলুদ সূর্যাস্ত । তার মাঝেই হাতড়ে বেড়ায় একটা মানে, পারপাস।
“চাবিটা রইল, বুঝলি তো? বেরনোর সময়ে বন্ধ করে জমা দিয়ে যাস। আজ আবার মঙ্গলবার কিনা, একটু পুজো –আচ্চা থাকে, জানিসই তো…হে হে।’’ চোখ টিপে একটা জঘন্য হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায় তপনদা, পেছন পেছন শিস দিতে দিতে বিরজু।
শীর্ষেন্দু একা বসে থাকে একটা টেবিলে। কলেজে বেশি কেউ নেই এখন, ক্যান্টিন তো ফাঁকাই।
চাবির গোছ টা নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছিল । একটা দূর, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা, মহাশূন্যের ডাকে ঘোর ভাঙল।
“ কফি হবে?”
টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আজ। পরনে সেই নীল প্রজাপতি, যেটাকে স্বপ্নে ডানা মেলে উড়তে দেখে শীর্ষেন্দু।
তড়িঘড়ি উঠে কফি মেশিন থেকে এক কাপ কফি বানায়। এগিয়ে দেয় অচেনা বিষণ্ণ এক মুখের দিকে ।
মেয়েটা কিন্তু বেরিয়ে যায় না। কফি নিয়ে বসে সেই টেবিলটায় যেটায় এতক্ষণ শীর্ষেন্দু বসেছিল। ওর চাবিটা ওখানে এখনো। দূর থেকে দেখতে থাকে একজোড়া মনমরা চোখ কমলা হলুদ সূর্যাস্ত দেখছে। ও ও হয়তো পারপাস হাতড়ে ফিরছে।
চাবিটা আনতে যায় সন্তর্পণে, নিজের আধখাওয়া চায়ের কাপ টাও ওখানে এখনও, পরিষ্কার করতে হবে। সামনে গিয়ে একঝলক তাকাতে যায় আড়চোখে, ধরা পড়ে যায় ।
“বোসো” অচিনপুরের ঈশান কোণে বহুদিন বাদে কালো মেঘের আভাস বয়ে নিয়ে আসে শব্দটা ।
শীর্ষেন্দু বসে।
তারপর আর সামলাতে পারে না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে অবুঝের মত। এতদিনের জমানো বৃষ্টিরা কালো মেঘের সামনে অভিমান ফেটে বেরোয়। সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেতে যেতে বোঝে ওর হাতের ওপর ভোরের ঝড়ের ঠাণ্ডা স্পর্শ।
চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামে, আর ঝড়। অনেক ভোরের স্বপ্ন ভেঙে শীর্ষেন্দু উঠে বসে, জানলার পাশে দাঁড়ায়, না আজ আর দীর্ঘশ্বাস নয়, আজ সত্যি নেমেছে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি।